শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা এবং লেখা) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজের যে কথাগুলি নিয়ে আজকে এখানে আলোচনা হবে সেগুলি আগে টুকরো-টুকরোভাবে “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”-য় আলোচনা হয়েছিল। এখন সেইগুলি আরও বিস্তারিতভাবে করা হবে। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” ….. উপাসনা প্রসঙ্গে প্রথমেই এসে পড়ে ইষ্ট। সেইহেতু ইষ্ট বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। যাঁর স্মরণে বা অনুশীলনে মানবের সমগ্র অনিষ্ট দূরীভূত হয় – তাই মানবের ইষ্ট। ইষ্টকে একান্তভাবে আত্মভাবনা না করলে ইষ্টের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত হয় না, আর ভালোবাসা জাগ্রত না হোলে আত্মসমর্পনের ভাব আসে না। আবার আত্মসমর্পনের ভাব না এলে ভগবৎপ্রেম লাভ হয় না। সুতরাং ভগবৎ-প্রেম লাভ করতে হোলে আত্মসমর্পনভাব একান্ত প্রয়োজন।”
তাহলে বোঝা গেল যে, উপাসনার জন্য ‘ইষ্ট’কে প্রয়োজন। এই ‘ইষ্ট’ দেশ-কাল-পাত্র ভেদে পৃথক-পৃথক হতে পারে – তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু, ‘ইষ্ট’ তিনিই, যাঁকে স্মরণ করলে যে তত্ত্ব জীবনে অনুসরণ করলে জীবনের অনিষ্ট দূরীভূত হয়। সুতরাং আমাদের উপাস্য বা ইষ্ট এমনটা কখনোই হওয়া উচিৎ নয় – যাঁর স্মরণে, যাঁর শিক্ষা অনুশীলন করে জীবনে নানান অনিষ্ট নেমে আসে। এইভাবেই ‘ইষ্ট নির্বাচন’ মানবজীবনে একটা অন্যতম এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়।
ইষ্ট-নির্বাচনে ভ্রান্তি আসা মানেই – সমগ্র জীবনটাই ভুলে ভরে যাওয়া! কি প্রকারে সঠিকভাবে সাধনা বা উপাসনা করা যায়, সে ব্যাপারে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” ইষ্টকে আত্মভাবে চিন্তা করতে হয় এবং ভাবে তন্ময়তা এলে একাত্মস্বরূপ হওয়া যায়। ভয় এবং হীনমন্যতা দ্বারা উপাসনা করলে ভগবৎপ্রেমের আবির্ভাব হয় না।” এই কথাগুলোও খুবই interesting ! কারণ ইষ্টকে আত্মভাবে চিন্তা করে, তন্ময় হয়ে, একাত্মস্বরূপ হোতে হয়। ভয় বা হীনমন্যতা নিয়ে উপাসনা করলে ভগবৎপ্রেম লাভ হয় না। সুতরাং এটাই বোঝা গেল যে, জগতে শত শত উপাসনা পদ্ধতি থাকতে পারে কিন্তু শ্রেষ্ঠ উপাসনা পদ্ধতি সেটাই হবে__ যেখানে উপাস্যের প্রতি উপাসকের আত্মভাব, আত্মার আত্মীয়ভাব বজায় থাকবে, কোনো ভয়-ভাব বা হীনমন্যতা থাকলে চলবে না।
এইজন্যেই গুরুমহারাজ বললেন – ” ….. ইষ্টকে অতি আপন অর্থাৎ প্রাণের প্রাণ, হৃদয়ের ধন – এইরূপ একান্তভাবে আত্মভাবনা না করলে ইষ্টের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা আসে না।” এই কথাগুলি বলার পরে গুরুমহারাজ আমাদেরই মনের কিছু জিজ্ঞাসা নিজেই তুলেছেন এবং নিজেই উত্তর দিয়ে আমাদেরকে পরিষ্কার করে ‘উপাসনার উদ্দেশ্য’ বুঝিয়ে দিয়েছেন। উনি এরপর বলেছেন – ” প্রশ্ন হোতে পারে – আত্মসমর্পণের ভাব কিভাবে আসে ? উত্তরে বলতে হয় – অপকট বিশ্বাস হোতে আসে শ্রদ্ধা এবং শ্রদ্ধা হোতে আসে আনুগত্য, আনুগত্যের গভীরতাই হোলো উৎসর্গ, আর আত্মোৎসর্গই হোলো আত্মসমর্পন ! ইষ্টের প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসার উৎকণ্ঠা বা ব্যাকুলতা এনে দেয় আত্নসমর্পনের ভাব। আর আত্মসমর্পনের পরিণতি-স্বরূপ ভগবৎ-প্রেমের আবির্ভাব বা অমৃতলাভ। যা লাভ হোলে ভক্ত আর কিছুই চায় না।৷”
এতক্ষণে গুরুমহারাজ ‘ভক্ত’ কথাটি উল্লেখ করলেন। আসলে ভক্ত ছাড়া যে ভগবৎপ্রেমের আস্বাদন অন্য কেউ করতে পারে না৷ ধ্যানী, জ্ঞানী, যোগী, সাধক এঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে চরমভূমিতে পৌঁছানোর পর তাঁদের সামনে শুধু একটা প্রাপ্তিই পাবার থাকে – আর তা হোলো ভগবৎ-প্রেমের আস্বাদন ! এইজন্যেই বলা হয় সব সাধনা বা সমস্ত রকমের উপাসনার অন্তে হোলো – প্রেম-সাধনা ! প্রেম-ই চূড়ান্ত ! প্রেম-ই পুরুষার্থ ! এই কথা জানতে পারার পর বহু সাধক প্রথমেই প্রেম-সাধনায় রত হয়ে যায় এবং মনে করে যে, সে ঐ সাধনায় সিদ্ধ হয়ে যাবে ! কিন্তু হায়! তা যে হবার নয়, তাই একশ জনের মধ্যে নিরানব্বই জন-ই ব্যর্থকাম হয়, অধঃপতিত হয়। গুরুমহারাজের অধ্যাত্মবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় সারকথাগুলির অন্যতম একটি (যেটি বারবার-ই উল্লেখ করা হয়) হোলো – ” কর্ম হোক ধ্যান, ধ্যানে ভর করুক জ্ঞান এবং জ্ঞানের সিংহাসনে বিরাজ করুক প্রেম – এটাই অধ্যাত্মবিজ্ঞান !” সুতরাং এই বিজ্ঞান মেনে সাধককে অধ্যাত্মপথে অগ্রসর হোতে হয় – না হোলে নানারকম দূরাগ্রহের সম্মুখীন হোতে হয় সাধককে। আর যে লাইনটায় গুরুমহারাজ বিশ্বাস–> শ্রদ্ধা–> আনুগত্য–> উৎসর্গ–> আত্মোৎসর্গ–> আত্মসমর্পন, এই যে অসাধারণ ক্রমের কথা বলেছেন – এটাও উনি অধ্যাত্মবিজ্ঞানের কথাই বলেছেন।
আমাদের মতো মাথামোটা অতি সাধারণ মানুষজনেদেরকে বোঝানোর জন্য গুরুমহারাজ কত সহজ-সরল করে অধ্যাত্মবিজ্ঞানের সকল রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছেন । আর এই কথা স্মরণ করে এই যুগপুরুষ করুণাময় ভগবানের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-প্রণতি না জানিয়ে কোনো উপায় থাকে না।
যাইহোক, গুরুমহারাজের বলা পরবর্তী কথায় যাই ! উনি এরপর বলেছেন – “প্রেম-ই পরমেশ্বর, যাঁর প্রাপ্তিতে আর চাওয়ার কিছুই থাকে না। ভক্তিযোগের এবং ভগবৎ উপাসনার এটাই হোলো চরম পরিণতি বা পরম প্রাপ্তি। এককথায় দ্বিধাহীন চিত্তে ইষ্টে অনুরক্তিই ভক্তি !” প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের বলা এই কথা থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, জগতে যত রকমের ‘উপাসনা’ রয়েছে – সেগুলো সবই ভক্তিযোগের-ই অঙ্গ। জ্ঞানযোগ-রাজযোগ ইত্যাদিতে পূজা-স্তব-স্তুতি-উপাচার ইত্যাদির স্থান নাই, ওইগুলোতে সাধকের যেন বীরভাব। আর ভক্তিযোগ দুর্বল মানবের একমাত্র হাতিয়ার। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে করুণা আদায় করা ! ভক্তিযোগেই লীলা প্রকটিত হয় ভক্তের সাথে ভগবানের লীলা !