শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লেখা ও বলা) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের লেখা ‘সহজতা ও প্রেম’ (যে গ্রন্থকে গুরুমহারাজ বলেছিলেন – আগামী দিনের ‘গীতা’র ন্যায় মর্যাদা পাবে।) থেকে লাইন তুলে সেইগুলো নিয়েই আলোচনা করছিলাম। এখন আমরা উপাসনা, সাধনা, আরাধনা – ইত্যাদি প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম। এবার গুরুমহারাজ ভক্তিযোগের প্রসঙ্গে কী বলেছেন, তা একটু দেখে নেওয়া যাক্। উনি বলেছেন – “…. ভক্তিযোগের কতকগুলি অনুশীলন আছে – যার অভাবে আরাধনা পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। অনুশীলনগুলি হোলো – সর্বভূতে বা সর্বজীবে প্রীতি ও ভালোবাসা, সর্বোপরি নীচ স্বার্থ ভাবনা ভুলে সর্বভূতের নিমিত্ত কল্যাণ কামনা করা এবং সকলের নিমিত্ত ব্যক্তি সুখ-সুবিধা ও স্বার্থত্যাগ করা।” এই যে কথাগুলি গুরুমহারাজ বললেন – ঠিক এইভাবে ভক্তিশাস্ত্রে কোথাও এতো পরিষ্কারভাবে তার উল্লেখ করা হয়নি। মহাপ্রভুর নিজের জীবনাদর্শে এগুলি দেখিয়ে গিয়েছিলেন এবং চৈতন্য পরবর্তী ষড়গোঁসাইগণ এবং আরো কিছু মহাজনগণ নিজেদের জীবনে ঐ সকল ‘আদর্শ’ পরিস্ফুট করেছিলেন। মহাপ্রভু আদর্শ বৈষ্ণবের আচরণ বোঝাতে বলেছিলেন – ” তৃণাদপি সূনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা ; অমানিনা মান দেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরি !”
বর্তমান বৈষ্ণবগণ সাধন-ভজন, শাস্ত্রপাঠ, বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ইত্যাদি খুবই করে থাকেন। কিন্তু ‘সর্বভূতে প্রীতি ও ভালোবাসা, স্বার্থভাবনা সম্পূর্ণরূপে ভুলে – সদাসর্বদা সকলের নিমিত্ত কল্যাণকামনা এবং নিজস্বার্থ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা’ – এই ভাবনা ভক্তিভাবের সাধকদের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না। যদি কারও মধ্যে সাধন-ভজনের সাথে সাথে ঐ ভাবগুলিও বিদ্যমান থাকে – তাহলেই তিনি যথার্থ ভক্তিযোগী এবং তাঁর-ই প্রেমলাভ হবে – বাকিদের শুধু নাচা-কোঁদাই সার আর কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলানোই সার। ‘কাজের কাজ’ বিশেষ কিছুই হয় না(কিছু কাজ নিশ্চয়ই হয়, কিন্তু ‘কাজের কাজ’–হয় না।) !
যাইহোক, এরপর গুরুমহারাজ ‘উপরিউক্ত ভাব’ থাকলে কি হয়, সেই সম্বন্ধে কি বললেন সেটাই দেখা যাক্ ! উনি বললেন – “এইরূপ সুমহান ত্যাগের মহিমায় ভক্তিযোগীর অন্তর বৈরাগ্যের আলোকে জ্যোতিস্মান হয়ে ওঠে – দেহ, মন ও বাক্য পবিত্র হয়। তখন ভগবৎপ্রেম দিব্যধারায় বিগলিত হোতে থাকে ভক্তিযোগীর অর্ন্তদেশে। সুতরাং সর্বভূতে ভালোবাসা ও তার জন্য নিজ স্বার্থত্যাগ – এটাই ভক্তিযোগের চরম আদর্শ। ভক্তিযোগ__ ত্যাগ ও ভালোবাসার শিক্ষা প্রদান করে থাকে। বর্তমানে আত্মম্ভরিতা, স্বার্থান্ধতা, নিষ্ঠুরতা, সংঘর্ষ ও সামাজিক অশান্তির একমাত্র কারণ প্রেমের অপূর্ণতা।” শুধু ভক্তিযোগী-ই নয়, যে কোনো মার্গের যোগীর-ই সিদ্ধ অবস্থায় দেহ-মন-বাক্যের পবিত্রতা আসে। কারণ সুমহান ত্যাগ ও বৈরাগ্য না থাকলে কোনো যোগে-ই সিদ্ধি আসে না। তাই পূর্ণতা প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত-ই হোলো ত্যাগ ও বৈরাগ্য।
তবে গুরুমহারাজ এখানে শুধুমাত্র ভক্তিযোগীদের উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছেন। তাই আমরা দেখছি যে, ওনার কথায় ভক্তিযোগীর চরম পুরুষার্থ যে ‘প্রেমলাভ’– সেই কথার সুনিপুণ উপস্থাপনা করেছেন – ” ভগবৎপ্রেম দিব্যধারায় বিগলিত হোতে থাকে ভক্তিযোগীর অর্ন্তদেশে।” ভগবৎপ্রেমের আস্বাদন তো ভক্তের অর্ন্তদেশে-ই হয় – সেই অবস্থায় সাধক বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, স্থূল ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়াশীলতা হারায় ! তাছাড়া উনি আরও যে কথার উপর আলোকপাত করেছেন তা হোলো – ‘ভক্তিযোগ ত্যাগ ও ভালোবাসার শিক্ষা প্রদান করে থাকে।’ তাইতো যথার্থ ত্যাগভাব এবং যথার্থ প্রেমভাব যার মধ্যে প্রস্ফুটিত হয় সেই ভক্তিযোগের প্রকৃত অধিকারী।
আর যে জিনিসটা গুরুমহারাজ তুলে ধরলেন তা হোলো – সমাজে বসবাসকারী মানুষদের (জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে) মধ্যে প্রেমভাব জাগ্রত করা একান্ত প্রয়োজন, কারণ প্রেমের অপূর্ণতা রয়েছে বলেই সমাজের মানুষের মধ্যে আত্মম্ভরিতা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, সংঘর্ষ এবং নানা প্রকারের অশান্তি ঘটানোর মানসিকতা তৈরি হোচ্ছে। মানুষের জীবনে প্রেম প্রকটিত হোতে থাকলে সেই মানুষের মধ্যে উপরোক্ত ভাগগুলির বিলোপ-সাধন ঘটে এবং সে নিজে শান্ত হয় বলেই শান্তির সন্ধান পায়। আর যে শান্তির সন্ধান পেয়েছে – সেই পারে সমাজের অপর ব্যক্তিদেরকেও শান্তির সন্ধান দিতে।
এরপর গুরুমহারাজ উপাসনার নিমিত্ত প্রতীক, প্রতিমা বা মূর্তি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করেছেন। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – এই আরাধনায় অধিকারীভেদে প্রতীকের প্রয়োজন হয়ে থাকে। কারণ রূপ ও রেখার মধ্যে দিয়েই মানবমনের ধর্ম প্রকাশিত। সেইজন্য প্রতীক ছাড়া চিন্তা করা মানবিক স্তরে অসম্ভব।” এইটা বড়ই বাস্তব কথা ! মানবিক স্তরে ‘রূপ ও রেখা’ ছাড়া বা কোনো প্রতীক ছাড়া চিন্তা করাই অসম্ভব ! তাহলে আমরা যারা “মানবিক স্তরে” রয়েছি (দৈবিক স্তর বা ঋষি অবস্থার স্তরের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র) – আমাদের যদি পরমেশ্বর (ঈশ্বর, আল্লাহ, গড – ইত্যাদি)-এর চিন্তা করতে হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই প্রতীক বা প্রতিমা অথবা মূর্তির প্রাথমিকভাবে একান্ত প্রয়োজন।
এরপর গুরুজী বলেছেন – ” মানবের মন যতক্ষণ জান্তব অবস্থা বা অবিকশিত অবস্থায় থাকে, ততক্ষণ তার প্রতীকের অবশ্যই প্রয়োজন। মানবের মনের বিকাশের সাথে সাথে আরাধ্য প্রতীকের গুণগুলি (উপাসকের) চিন্তার বিষয় হয়ে পড়ে। তাহলে আমরা এটা বুঝতে পারলাম যে– আমরা অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরা মানবিক চেতনায় থাকলেও আমাদের মধ্যে জান্তব চেতনাও বিদ্যমান। আর যতক্ষণ জান্তব চেতনা রয়েছে, ততক্ষণ ঈশ্বরচিন্তার জন্য অবশ্যই আমাদের প্রতীক বা প্রতিমার প্রয়োজন। আমাদের চেতনা উন্নত হোতে শুরু করলে তখন আর প্রতীকের প্রয়োজন হয় না – তখন উপাস্য বা ইষ্টের গুণগুলি স্মরণ-মনন করলেই উপাসনা সম্পন্ন হয়। মানবিক ক্রমবিকাশের এই ক্রমটাই গুরুমহারাজ বোঝাচ্ছেন। উনি বলছেন – ” তারপর মনের বিকাশের সাথে সাথে গুণও বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন আসে এক চূড়ান্ত পরিণতি – যা (মানবের) মানবিক স্তরের ঊর্ধ্বে – প্রকৃত সহজ আনন্দ বা ভূমানন্দ। ভক্ত সমাহিত হয় ভগবানে। আনন্দ প্রতিষ্ঠিত – ঈশ্বরের করুণা অপার।৷”