শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা কথা (লেখা এবং বলা) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখানে এখন ‘উপাসনা’ সম্বন্ধে গুরুমহারাজ যে সমস্ত আলোচনা করেছিলেন সেইগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। আগের দিনের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম গুরুজী জোর দিয়ে একটা কথা বলেছিলেন যেটা হোলো – পৃথিবীর সমস্ত ধর্মমতেরই আচার-অনুষ্ঠান, উপাসনা পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের নাম এবং তাঁর অবস্থান নিয়েও মতের ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু সেসব থাকা সত্ত্বেও সকল ধর্মমতের উপাসকেরাই স্বীকার করে যে, পরমেশ্বর (আল্লা, হরি, গড ইত্যাদি) সর্বশক্তিমান এবং তাঁর সবকিছুই করার সামর্থ্য রয়েছে ! তবু আমরা গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে দ্বন্দ্ব-বিবাদ করি, ঝগড়া-মারামারি করি। কি মূর্খতা ! কি আহাম্মক আমরা ! গুরুজী ঠিকই বলেন – ” পৃথিবী গ্রহটাই এখনো শিশু অবস্থায় রয়েছে, যেন হামাগুড়ি অবস্থা থেকে সবে উঠে দাঁড়াতে শিখেছে !”
এরপর এইসমস্ত ব্যাপারে গুরুমহারাজ আরও যা কিছু বলেছেন, সেগুলি শুনে নেওয়া যাক। উনি বললেন – ” প্রিয় আত্মন্ – পরমেশ্বর সর্বব্যাপী। পণ্ডিত হোতে মূর্খ, যোগী, ভোগী, রোগী, উত্তম, অধম এবং সমস্ত চরাচর বিশ্বে ঐ একই পরমেশ্বর বিরাজমান। যা দেখছাে – সবই তাঁর প্রকাশ ! নাম ও রূপে কেবল ভেদ বা বিচিত্রতা দৃষ্ট হোচ্ছে। এর কারণ অবিদ্যা। বিদ্যা ও অবিদ্যা ঐ একই শক্তির দুইটি ক্রিয়া। সুতরাং নিরাকার তত্ত্বই প্রেমাবেশে সাকার রূপ ধরে প্রতিভাসিত। আকারেই নিরাকার, আবার নিরাকারেই আকার। ভাণ্ডেতেই ব্রহ্মাণ্ড আবার ব্রহ্মাণ্ডেই ভাণ্ড ওতপ্রোত। বস্তুতঃ সেই তত্ত্ব নির্গুণ, সগুণ – এই দুইয়ের অতীত। একাধারে সমস্ত কিছুই তাঁর প্রকাশ ! এটাই সহজবোধে বোধিতত্ত্ব।”
গুরুমহারাজের এই কথাগুলো শুনে আমরা এটাই বুঝতে পারছি যে, সত্যি সত্যিই আমরা সমাজের সাধারণ মানুষেরা একেবারেই আহাম্মক, একেবারেই মানসিকভাবে শিশু অবস্থায় বিচরণ করছি ; নাহলে আমরা সকলেই সেই পরমেশ্বরের (আল্লা, হরি, গড ইত্যাদির) প্রকাশ !! তাহলে স্বরূপতঃ তো আমরা সকলে একই !! অথচ আমরা পরস্পরকে ভেদ দেখছি, ভিন্ন ভাবছি, আবার এই ভিন্নতা শুধু নাম বা রূপেই সীমাবদ্ধ রাখছি না – ধর্মীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে ইত্যাদি আরও নানাভাবে পরস্পর পরস্পরকে ভিন্ন ভিন্ন করে রাখছি ! কি মূর্খতা ! কি আহাম্মকি ! কি অজ্ঞানতা !
যাইহোক, এরপরে গুরুমহারাজের কথানুযায়ী__’অবিদ্যার’ কারণেই জগতে ভেদ বা বৈচিত্র দেখা যায় ! এই অবিদ্যাই অজ্ঞানতা ! এছাড়া উনি আরো একটা মজার কথা বলেছেন – ” নিরাকার তত্ত্বই প্রেমাবেশে সাকার রূপ ধরে থাকে।” তার মানে হোচ্ছে – ভক্তিযোগ বা প্রেমসাধনাতেই ‘সাকার’ উপাসনার প্রয়োজন হয়। আর সাধারণ মানুষ সহজ-সরল যোগ এই ভক্তিযোগকে আশ্রয় করেই প্রাথমিকভাবে আধ্যাত্মিক পথে উন্নীত হোতে পারেন৷
মহাবাউল গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ নিরাকার ও সাকারের ভেদ ভেঙে দিয়ে বললেন – ” সাকারেই নিরাকার আবার নিরাকারেই সাকার, ভাণ্ডেই ব্রহ্মাণ্ড আবার ব্রহ্মাণ্ডেই ভাণ্ড ওতপ্রোত !” কিন্তু কথাটি শেষ করলেন চরম হেঁয়ালিকে সামনে রেখে – কারণ এরপর উনি বললেন – ” বস্তুতঃ সেই তত্ত্ব (ব্রহ্মতত্ত্ব বা পরমেশ্বর তত্ত্ব) নির্গুণ-সগুণের অতীত !”
প্রিয় পাঠক ! তাহলে এবার কি করবেন ? এই যে আমাদের মধ্যে কেউ ভাবছি নিরাকার উপাসনাই শ্রেষ্ঠ, কেউ ভাবছি সাকার – কিন্তু আমরা উভয় দলের সমর্থকরাই তো চরম বোকা বনে গেলাম, কারণ আমাদের উপাস্য যে পরমেশ্বর__ সেই তত্ত্ব হোলো সগুণ বা নির্গুণের অতীত। তাহলে গুণ দিয়ে কিভাবে আমরা তাঁর বিচার করবো, _ তাঁর চিন্তা করবো,_ তাঁর সম্বন্ধে কথা বলবো ?? সেইজন্যেই বলা হচ্ছিলো – এই যে আমাদের মধ্যে এতো সম্প্রদায়, এতো গোষ্ঠী, এতো পরম্পরা – এগুলো সবই অবিদ্যা ও অজ্ঞানতার ফসল ছাড়া আর কিছুই নয়।
যাইহোক্, এরপর আমরা গুরুমহারাজের পরবর্তী বক্তব্যের দিকে অগ্রসর হই – দেখি এরপরে উনি এই বিষয়ে আর কি কি বলেছেন !
উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – এইবার ঐ ভক্তিযোগের প্রতীক উপাসনা বা মূর্তিপূজা হোলো আমাদের আলোচ্য বিষয় ! সাধারণতঃ মূর্তিপূজা যারা করেন, তাদের ভিতর কেউ কেউ ভেবে থাকেন যে, মূর্তি ছাড়া আর কোথাও ঈশ্বর নাই ! কিন্তু মূর্তিপূজার উদ্দেশ্য তা নয়। ঈশ্বর যখন সর্বত্রই আছেন বা তিনি যখন সর্বব্যাপী, সেহেতু মূর্তিতেও যে তিনি আছেন – এটা আশ্চর্যের কথা নয়। সুতরাং তাঁর উপাসনা অন্যভাবে যেমন সম্ভব – মূর্তিতেও সেইরূপ সম্ভব !” কি সহজ সরল সমাধান দেখুন ! পরমেশ্বর যখন সর্বব্যাপক, তখন কেনই বা তাঁকে ‘মূর্তির মধ্যেও তিনি রয়েছেন’– এই কল্পনা করে উপাসনা করা যাবে না ? নিশ্চয়ই যাবে !এইজন্যেই পূর্ববর্তী মহা-মহা সাধকদের অন্তরের অনন্য ভক্তিযুক্ত উপাসনায় মৃন্ময়ী বার বার কিভাবে চিন্ময়ী রূপে প্রকটিত হয়েছেন __ এই রহস্যটা এতোদিনে সুন্দর করে বোঝা গেল !!
এরপর গুরুজী বলছেন – ” কিন্তু যাঁরা সেই সর্বব্যাপী, সর্বময় সত্তাকে ধারণা করতে পারেন না – তাদের কথা স্বতন্ত্র ! আর যাঁরা জানেন ঈশ্বর সর্বব্যাপী অথচ তাঁকে ধারণা করতে পারছেন না – তাঁরাই মূর্তিপূজা বা প্রতীক উপাসনার অধিকারী। বস্তুঃত মূর্তিপূজা বা প্রতীক উপাসনা শুধুমাত্র প্রতীক উপাসনাই নয়, তা পরমেশ্বরেরই উপাসনা – মূর্তিকে মাধ্যম করে ! প্রতীক উপলক্ষ বা মাধ্যম মাত্র ! যারা মন্দিরে বা বিগ্রহে পরমেশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, আর কোথাও তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তারা আধ্যাত্মিক রহস্য অবগত নন।”
পৃথিবীতে যত প্রকারের পরমেশ্বরের উপাসনা পদ্ধতি রয়েছে, মূর্তিপূজার মাধ্যমে উপাসনাও তারই একটি। কিন্তু ‘এইটিই শ্রেষ্ঠ উপাসনা আর বাকি সব পদ্ধতি ঠিক নয়’ – এইরূপ ভাব যাদের মধ্যেই রয়েছে, তারা এখনো আধ্যাত্মিক রহস্য অবগত হন নি – এটাই গুরুমহারাজের সিদ্ধান্ত !