শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (বলা ও লেখা) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। ‘উপাসনা’ প্রসঙ্গে গুরুমহারাজের লেখা ‘সহজতা ও প্রেম’ গ্রন্থে গুরুমহারাজ আরও কি কি বলেছেন, আমরা এখন সেইগুলির দিকে চোখ বোলাই ! উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর সর্বভূতে আছেন। ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতা হেতু বিগ্রহে তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে মূর্তিকে উপলক্ষ‍্য করে পরমেশ্বরের উপাসনাই মূর্তিপূজার উদ্দেশ্য।” তাহলে গুরুজীর এই কথা থেকে আমরা মূর্তিপূজার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত হ’লাম। মূর্তি এখানে উপলক্ষ্য – লক্ষ্য পরমেশ্বরের উপাসনা। কিন্তু উপলক্ষ্য যদি লক্ষ্যকে ছাপিয়ে যায় অর্থাৎ মূর্তিপূজাকে কেন্দ্র করে আড়ম্বর-আয়োজনই বেশি হয় – আত্মস্থ হবার ভাব, চেতনার উন্নতির প্রচেষ্টা কম হয় – তাহলে সেই উদ্দেশ্যই বৃথা হয়ে যায়। তখন ‘উপাসনা’ সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়ে যায় – এর দ্বারা আর আত্মিক উত্তরণ বা বিবেকের জাগরণ হয় না !
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন – ” বস্তুতঃ মূর্তিপূজা উদারচিত্ত মনেরই প্রকাশ – সংকীর্ণচিত্ত মনের কল্পনাপ্রসূত নয়। মূর্তিপূজা সেই সর্বব্যাপী, সর্বময় পরমেশ্বরের প্রতীক মাত্র। (মূর্তিপূজা) পক্ষান্তরে পরমেশ্বরেরই উপাসনা ! এটাই মূর্তিপূজার রহস্য বা তাৎপর্য্য !” এই কথাগুলির মাধ্যমে গুরুমহারাজ পূর্বকথাগুলিকেই আরো জোরালো ভাবে মান্যতা দিতে চেয়েছেন৷ এখনো যদি মূর্তিপূজার ব্যাপারে আমাদের মনের সংশয় বিনষ্ট না হয়ে থাকে – উনি সেই সংশয় দূর করারই চেষ্টা করেছেন।
গুরুমহারাজ শুধু প্রতীক বা দেব-দেবীর মূর্তিপূজাই নয় – মানুষপূজা বা অন্যান্য জীব বা বৃক্ষের পূজা, অথবা যে কোনো জড়বস্তুর পূজা করাটাও যে সেই পরমেশ্বরেরই উপাসনা – সেই ব্যাপারটাই আমাদেরকে বোঝালেন। কারণ উনি বারবার করে আমাদের বুঝিয়ে বললেন যে, পরমেশ্বর (আল্লা, হরি, গড ইত্যাদি) সর্বব্যাপক–সর্বময় ! এই কথাগুলি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবো, যখন গুরুমহারাজের পরবর্তী কথাগুলির দিকে আমরা মনোনিবেশ করার চেষ্টা করবো। উনি এরপর বললেন – ” পরমেশ্বর সর্বব্যাপী – সর্বত্র বিরাজমান, মানুষের মাঝেও তাঁর প্রকাশ।”
এবার গুরুমহারাজ বললেন – “শাস্ত্রে লিখিত আছে যে, প্রতীক বা বিগ্রহ ভাবাত্মক। এই ভাবাত্মক মূর্তিকে অবলম্বন করে এবং লঙ্ঘন করে যেতে হবে অসীমে৷ আর অসীমে যাওয়াই সাধকের লক্ষ্য বা কর্তব্য।” এইখানে গুরুমহারাজ আমাদের মতো সাধারণ মূর্তিপূজক বা প্রতীক উপাসনাকারীদের চেতনায় চাবুক মেরেছেন ! উনি একথা বলেছেন যে – বিগ্রহ, মূর্তি বা প্রতীক এইগুলি ভাবাত্মক অর্থাৎ এইগুলির পিছনে গভীর ভাবনা-চিন্তা রয়েছে। রূপকাকারে এইগুলির মাধ্যমে কোনো ভাবকে ব্যক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সে যাইহোক, যেকোনো ভাবকে আশ্রয় করে বা অবলম্বন করে এবং প্রতীকের মাধ্যমে না হয় সাধকের উপাসনা শুরু হোলো – কিন্তু এবার এই ভাবাত্মক সবকিছুকে লঙ্ঘন করে পৌঁছাতে হবে অসীম তত্ত্বে। কারণ প্রতিটি ধর্মের (দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে) উপাসকগণের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সেই একটাই – অসীম তত্ত্বে পৌঁছানো।
এতদুর পর্যন্ত বলার পর গুরুমহারাজ আমাদের মতো আহাম্মক উপাসনাকারীদেরকে যথেষ্ঠ তিরস্কার করেছেন, আর তা করেছেন আমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত কাজকর্মের জন্যই ! মানবের উপাসনার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যহীনতা লক্ষ্য করে উনি বলেছেন – ” কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা দেখি এর সম্পূর্ণ বিপরীত, অমানবিকতা, অপকর্ম ও হাস্যকর সংকীর্ণতার প্রসার। আজ বিচারবিহীন আচার-অনুষ্ঠানই সত্য হয়েছে। মানবের বিচারবোধ–বুদ্ধিমত্তা – অজ্ঞান ও নির্বুদ্ধিতয় সমাচ্ছন্ন হয়েছে৷ সংকীর্ণ চেতনা ও আধ্যাত্মিক অজ্ঞানতার ফলে সমাজের শ্রেণিচেতনা, সম্প্রদায়চেতনা, গোষ্ঠীচেতনা ইত্যাদি প্রকাশ পাচ্ছে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! সত্যি কথা সরাসরি বললে সকলেরই একটু-আধটু রাগ, দুঃখ হয়,__তাই এইসব শুনে নিশ্চয়ই আপনাদেরও হোচ্ছে ! সত্যিই তো, আমরা বর্তমানে সকলেই অর্থাৎ ধর্মমত-নির্বিশেষে সকলেই বিচারবিহীন আচার-সর্বস্বতা নিয়েই পড়ে রয়েছি, আর এটাই আমাদের অজ্ঞানতা এবং নির্বুদ্ধিতা। সত্যিই তো আমরা কোনো না কোনো ধর্মমতের অনুসারী ঠিকই, কিন্তু সেই মতের উপাসনাকারী হওয়া সত্বেও আমাদের মধ্যে অমানবিক আচরণ, অপকর্ম ও সংকীর্ণতার প্রসার রোধ করতে তো পারিনি ! তাইতো গুরুমহারাজ আমাদেরকে তিরস্কার করে এই কথাগুলি বলেছেন।
তাহলে আমাদেরকে কি করতে হবে ? তার বিধানও পরমদয়াল গুরুজী-ই করে দিয়েছেন ! তিনিই আমাদের অজ্ঞান-অন্ধকার থেকে টেনে টেনে আলোর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন – তাঁর অনুপম দেবতনুকে জীর্ণ করে, বিদীর্ণ করে__ তিনি আমাদেরকে কৃপা ও করুণা দান করেছেন। তাই তো উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – জীবন তাঁর জীবন্ত বিগ্রহ। তাঁকে জানো – তাঁকে ভালোবাসো – তাঁকে সেবা করো। মস্তিষ্ক দিয়ে তাঁকে জানো, হৃদয় দিয়ে তাঁকে ভালোবাসো ও শরীর দিয়ে তাঁকে সেবা করো !”
সুধী পাঠক ! এইবার বোঝা গেল তো – যে জীবন তাঁর (পরমেশ্বরের) জীবন্ত বিগ্রহ, অর্থাৎ বিগ্রহ বা মূর্তি-প্রতিমা ইত্যাদি রূপক, প্রকৃতপক্ষে বিগ্রহ হোলো মানুষের এই জীবন!!
এইজন্যেই তো গুরুমহারাজ বারবার বলতেন – “এই দেহভাণ্ডেই ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব রয়েছে।” এই দেহ দিয়েই পরমেশ্বরের সার্থকভাবে উপাসনা করা যায় এবং সেই উপাসনাতেই মানবজীবনের উদ্দেশ্য সফল হয়। আর সঠিক উপাসনার জন্য মস্তিষ্ক (জ্ঞান) দিয়ে সেই পরমেশ্বরকে জানতে হয়, হৃদয় (অন্তঃকরণ) দিয়ে তাঁকে ভালবাসতে হয় এবং শরীরের সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে নিঃস্বার্থ সেবাকার্যে নিয়োজিত হতে হয়। (ক্রমশঃ)