গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ)-এর ভাই গৌতম এবং ওনার পরিবারের কথা হচ্ছিল । গৌতম যখন পাকাপাকিভাবে বনগ্রাম আশ্রমে শিক্ষক হিসাবে Join করল , তখন মনে হয় গুরু মহারাজ খুবই আশ্বস্ত হয়েছিলেন ৷ কারণ গৗেতমের স্ত্রী পার্বতী গুরু মহারাজের মা জননী নিভারানীর কাছে থাকতে পারতো! তবে এটি বেশীদিনের জন্য স্থায়ী হয়নি ৷ মা নিভারানী খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই গুরু মহারাজের কোলে মাথা রেখে বনগ্রাম আশ্রমে শরীর ছেড়ে দিলেন । গুরু মহারাজ শ্রাদ্ধ-শান্তির সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করেছিলেন ! অবশ্য নিয়মতান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মাদি ভাইরা ই সম্পন্ন করেছিলেন ।
মায়ের মৃত্যু ছিল গৌতমের জীবনে এটা বিরাট বিপর্যয় ! যতদিন ‘মা’ ছিলেন গৌতম যেন অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিল ! মায়ের মৃত্যুর পর দাদা (স্বামী পরমানন্দ) কি অতটা নজরে রাখবে ছোট ভাইকে ! কিন্তু গৌতমের এরূপ চিন্তা অমূলক ছিল । গুরু মহারাজ ছোট ভাই ‘খুদু’-কে (গুরু মহারাজ গৌতমকে ‘খুদু’ বলে ডাকতেন) সমানভাবেই স্নেহ করতেন ! এরপর এল সেই বিশেষ দিন – পরমানন্দ ভক্তদের জীবনে সবচাইতে বিপর্যয়ের দিন – ১৯৯৯ সালের ২৭শে নভেম্বর !!! সেদিনকার চিত্র যাদের মনে আছে বা সেদিনের ভিডিও যারা দেখেছন – তাদের মনে থাকার কথা গুরু মহারাজের নিথর শরীরের ঠিক পাশটায় বুকে জোড়া হাত রেখে Stand-still দাঁড়িয়ে গৌতম – গুরু মহারাজের ছোট ভাই গৌতম !!
এরপর থেকেই ওর সংগ্রামময় জীবনের সূত্রপাত হয় । আশ্রমের বিদ্যালয়ে পড়ানো ছাড়াও কিছু Tution ধরতে হয়েছিল গৌতমকে ! এইভাবে চলছিল , কিন্তু গুরু মহারাজদের বাড়ীর প্রায় বংশগত রোগ ‘রক্তে সুগার’ গৌতমকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল । ফলে ও বারবার অসুস্থ হতে থাকল ! গুরু মহারাজ থাকাকালীন সময় থেকেই বনগ্রাম আশ্রমের কারো কোনকিছু হলেই দুটি নার্সিংহোমের দরজা সর্বদাই খোলা থাকতো ! ১নং – বর্ধমানের অমরবাবুর ‘বেঙ্গল নার্সিংহোম’ এবং ২নং – কামারকুন্ডুর হারাধন মান্নার নার্সিংহোম ৷
প্রথমদিকে গৌতম যতবারই অসুস্থ হোত – ততবারই এই দুই জায়গার মধ্যে যে কোন একটিতে ভর্ত্তি করে দিত আশ্রম কর্তৃপক্ষ । ব্লাড-সুগারের সবচাইতে বড় সমস্যা হোল বারবার ঘা-ফোঁড়া হওয়া ! আর কোন ঘা বা ফোঁড়া একবার হলে – তা আর ভালো হতে চায় না ! ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে এবং ভিতরে ভিতরে বহু দূর পর্যন্ত পচন ধরে যায় । গৌতমের ক্ষেত্রে এমনই সব হচ্ছিল । বর্ত্তমান আশ্রম অধ্যক্ষ স্বামী পরমেশ্বরানন্দ মহারাজ (তৃষাণ মহারাজ) ঐ দুটি নার্সিংহোম ছাড়াও বেশ কয়েকবার কলকাতার নামীদামী হসপিটাল বা নার্সিংহোমে গৌতমকে রেখে অপারেশন করিয়ে নিয়ে আসেন ! আর শেষকাল টায় কলকাতার P. G. Hospital-এ ভর্ত্তি করেন ! খুবই উন্নত ব্যাবস্থার মধ্যে ওকে রাখা হয়েছিল এবং ওখানকার সবচাইতে বড় বড় ডাক্তারেরা গৌতমের চিকিৎসা করেছিল ! কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গৌতম গত ১৬-ই জানুয়ারী শরীর ছেড়ে পরমানন্দলোকে চলে যায় ৷
এইতো গেল গৌতমের সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন । এবার আসি গৌতমের সাথে আমার বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসা গুরু মহারাজ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য ! ‘অজানা’ অর্থে যেগুলি গুরু মহারাজের কাছে শোনা নয় – গৌতমের কাছে শোনা । আমি গৌতমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” তুমি ছোটবেলায় তোমার দাদা (গুরু মহারাজ)-কে ঠিক কেমন দেখেছিলে ?”
গৌতম বলত _”দ্যাখো, ছোটবেলায় দাদা(গুরুমহারাজ)-কে আর কতটুকুই বা দেখতে পেতাম! বাড়িতে তো খুবই কম আসতো! হয়তো রাত্রিতে আসতো__আবার খুব ভোরে উঠে চলে যেত। ফলে সেভাবে আর মেলামেশা করা হয়ে ওঠেনি। তবে মনে আছে খুব ছোটবেলায় আমাকে কোলে নিয়ে আদর কোরতো। ”
এইসব শোনার পর আমি গৌতমকে জিজ্ঞাসা করতাম_’আচ্ছা, খুব ছোটবেলায় নাহয় ওতটা পাওনি বা ওনাকে ওতটা বুঝতে পারোনি_কিন্তু একটু বড় হবার পরের কথাগুলো তো মনে আছে! সেগুলোই বলো!’
গৌতম বলতো ওর যখন ৫/৬-বছর বয়স, সেই সময়কার কথা! বলল যে ও(গৌতম) তখন দেখতো যে, বাবা এবং মা রবিদাদা কে একটু বেশি বেশি মান্যতা দিতো! বাড়ির সবাই জানতো যে _দাদা(গুরুমহারাজ) আর পাঁচজনের চাইতে আলাদা! কিন্তু এসব তো আমরা বুঝতাম না _রবিদাদা যখনই বাড়ি আসতো, তখনই আমাদের খুবই আনন্দ হোত! সেটা অবশ্য অন্য কারনে! রবিদাদা চলে যাবার আগে আমাদের ছোটদের সকলকে ‘চারআনা’ করে পয়সা দিয়ে যেতো(তখন চারআনা পয়সার অনেকটাই দাম ছিল! বিশেষত ছোটদের ক্ষেত্রে!)।
গৌতম আরও বলত _”দাদা (গুরুমহারাজ) মাঝে মাঝে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের গাছ থেকে বুনো জাম পারতো। রবিদাদা গাছে উঠে জাম পেড়ে পেড়ে ঝোলায় পুরতো, আর যেগুলি নিচে পড়ে যেত _আমরা ছোটরা সেগুলি কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করে রাখতাম, খেতামও! দাদা গাছ থেকে নেমে এসে জড়ো করা জাম গুলি ব্যাগে ভরে নিয়ে কোথায় চলে যেত! তবে যাবার আগে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে ‘সিকি'(চারআনা) দিতে ভুলতো না! [ওর(গুরুজীর) কখনো ভূল হয়? গুরুমহারাজের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য পরের দিন!]
(ক্রমশঃ)
মায়ের মৃত্যু ছিল গৌতমের জীবনে এটা বিরাট বিপর্যয় ! যতদিন ‘মা’ ছিলেন গৌতম যেন অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিল ! মায়ের মৃত্যুর পর দাদা (স্বামী পরমানন্দ) কি অতটা নজরে রাখবে ছোট ভাইকে ! কিন্তু গৌতমের এরূপ চিন্তা অমূলক ছিল । গুরু মহারাজ ছোট ভাই ‘খুদু’-কে (গুরু মহারাজ গৌতমকে ‘খুদু’ বলে ডাকতেন) সমানভাবেই স্নেহ করতেন ! এরপর এল সেই বিশেষ দিন – পরমানন্দ ভক্তদের জীবনে সবচাইতে বিপর্যয়ের দিন – ১৯৯৯ সালের ২৭শে নভেম্বর !!! সেদিনকার চিত্র যাদের মনে আছে বা সেদিনের ভিডিও যারা দেখেছন – তাদের মনে থাকার কথা গুরু মহারাজের নিথর শরীরের ঠিক পাশটায় বুকে জোড়া হাত রেখে Stand-still দাঁড়িয়ে গৌতম – গুরু মহারাজের ছোট ভাই গৌতম !!
এরপর থেকেই ওর সংগ্রামময় জীবনের সূত্রপাত হয় । আশ্রমের বিদ্যালয়ে পড়ানো ছাড়াও কিছু Tution ধরতে হয়েছিল গৌতমকে ! এইভাবে চলছিল , কিন্তু গুরু মহারাজদের বাড়ীর প্রায় বংশগত রোগ ‘রক্তে সুগার’ গৌতমকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল । ফলে ও বারবার অসুস্থ হতে থাকল ! গুরু মহারাজ থাকাকালীন সময় থেকেই বনগ্রাম আশ্রমের কারো কোনকিছু হলেই দুটি নার্সিংহোমের দরজা সর্বদাই খোলা থাকতো ! ১নং – বর্ধমানের অমরবাবুর ‘বেঙ্গল নার্সিংহোম’ এবং ২নং – কামারকুন্ডুর হারাধন মান্নার নার্সিংহোম ৷
প্রথমদিকে গৌতম যতবারই অসুস্থ হোত – ততবারই এই দুই জায়গার মধ্যে যে কোন একটিতে ভর্ত্তি করে দিত আশ্রম কর্তৃপক্ষ । ব্লাড-সুগারের সবচাইতে বড় সমস্যা হোল বারবার ঘা-ফোঁড়া হওয়া ! আর কোন ঘা বা ফোঁড়া একবার হলে – তা আর ভালো হতে চায় না ! ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে এবং ভিতরে ভিতরে বহু দূর পর্যন্ত পচন ধরে যায় । গৌতমের ক্ষেত্রে এমনই সব হচ্ছিল । বর্ত্তমান আশ্রম অধ্যক্ষ স্বামী পরমেশ্বরানন্দ মহারাজ (তৃষাণ মহারাজ) ঐ দুটি নার্সিংহোম ছাড়াও বেশ কয়েকবার কলকাতার নামীদামী হসপিটাল বা নার্সিংহোমে গৌতমকে রেখে অপারেশন করিয়ে নিয়ে আসেন ! আর শেষকাল টায় কলকাতার P. G. Hospital-এ ভর্ত্তি করেন ! খুবই উন্নত ব্যাবস্থার মধ্যে ওকে রাখা হয়েছিল এবং ওখানকার সবচাইতে বড় বড় ডাক্তারেরা গৌতমের চিকিৎসা করেছিল ! কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গৌতম গত ১৬-ই জানুয়ারী শরীর ছেড়ে পরমানন্দলোকে চলে যায় ৷
এইতো গেল গৌতমের সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন । এবার আসি গৌতমের সাথে আমার বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসা গুরু মহারাজ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য ! ‘অজানা’ অর্থে যেগুলি গুরু মহারাজের কাছে শোনা নয় – গৌতমের কাছে শোনা । আমি গৌতমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” তুমি ছোটবেলায় তোমার দাদা (গুরু মহারাজ)-কে ঠিক কেমন দেখেছিলে ?”
গৌতম বলত _”দ্যাখো, ছোটবেলায় দাদা(গুরুমহারাজ)-কে আর কতটুকুই বা দেখতে পেতাম! বাড়িতে তো খুবই কম আসতো! হয়তো রাত্রিতে আসতো__আবার খুব ভোরে উঠে চলে যেত। ফলে সেভাবে আর মেলামেশা করা হয়ে ওঠেনি। তবে মনে আছে খুব ছোটবেলায় আমাকে কোলে নিয়ে আদর কোরতো। ”
এইসব শোনার পর আমি গৌতমকে জিজ্ঞাসা করতাম_’আচ্ছা, খুব ছোটবেলায় নাহয় ওতটা পাওনি বা ওনাকে ওতটা বুঝতে পারোনি_কিন্তু একটু বড় হবার পরের কথাগুলো তো মনে আছে! সেগুলোই বলো!’
গৌতম বলতো ওর যখন ৫/৬-বছর বয়স, সেই সময়কার কথা! বলল যে ও(গৌতম) তখন দেখতো যে, বাবা এবং মা রবিদাদা কে একটু বেশি বেশি মান্যতা দিতো! বাড়ির সবাই জানতো যে _দাদা(গুরুমহারাজ) আর পাঁচজনের চাইতে আলাদা! কিন্তু এসব তো আমরা বুঝতাম না _রবিদাদা যখনই বাড়ি আসতো, তখনই আমাদের খুবই আনন্দ হোত! সেটা অবশ্য অন্য কারনে! রবিদাদা চলে যাবার আগে আমাদের ছোটদের সকলকে ‘চারআনা’ করে পয়সা দিয়ে যেতো(তখন চারআনা পয়সার অনেকটাই দাম ছিল! বিশেষত ছোটদের ক্ষেত্রে!)।
গৌতম আরও বলত _”দাদা (গুরুমহারাজ) মাঝে মাঝে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের গাছ থেকে বুনো জাম পারতো। রবিদাদা গাছে উঠে জাম পেড়ে পেড়ে ঝোলায় পুরতো, আর যেগুলি নিচে পড়ে যেত _আমরা ছোটরা সেগুলি কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করে রাখতাম, খেতামও! দাদা গাছ থেকে নেমে এসে জড়ো করা জাম গুলি ব্যাগে ভরে নিয়ে কোথায় চলে যেত! তবে যাবার আগে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে ‘সিকি'(চারআনা) দিতে ভুলতো না! [ওর(গুরুজীর) কখনো ভূল হয়? গুরুমহারাজের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য পরের দিন!]
(ক্রমশঃ)