শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত ও লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আগের এপিসোডে আমরা গুরুমহারাজের আলোচনায় আমরা মানবজীবনের জয়গানের কথা শুনেছিলাম। উনি বলেছিলেন – ” জীবন তাঁর (পরমেশ্বরের) জীবন্ত বিগ্রহ।” তাছাড়া উনি আরও উল্লেখ করেছিলেন – “ভান্ডে ব্রহ্মান্ড” তত্ত্বের কথা৷ আমরা আগের আগের মহাপুরুষদের জীবনী পর্যালোচনা করে দেখেছি যে, তাঁরা সকলেই “জীবনের পূজারী” ছিলেন। তাঁরা সকলেই ছোটো বয়স থেকেই সুতীব্র সাধনার দ্বারা নিজেদের জীবনকে পূজার নৈবেদ্যরূপে প্রস্তুত করে পরমেশ্বরের চরণে নিবেদন করেছিলেন। আর এটাই হোলো সঠিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতেই পরমেশ্বর (আল্লাহ, হরি, গড ইত্যাদি) পূজা গ্রহণ করেন।
ফল-মূল-বেলপাতা-মিষ্টান্নের নৈবেদ্য তো মানুষের প্রয়োজনে (প্রসাদ গ্রহণ) নিবেদিত হয়। মানুষ যেগুলি গ্রহণ করতে ভালোবাসে সেইগুলিই সে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে এবং ভাবে যেহেতু সে নিজে প্রসন্ন হয়েছে – অতএব দেবতাও এতেই প্রসন্ন হবে !
এই উদ্দেশ্যেই সকলে তার নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে (দেব-দেবী অর্থাৎ মূর্তিরূপে বা অমূর্ত্তের উদ্দেশ্যে) অনেক কিছু offer করে থাকে। পশুবলি (ছাগবলি, মেষবলি, মোষবলি অথবা গরু, মেষ বা উট জবাই) ব্যাপারটাও এখান থেকেই এসেছে। গৃহপালিত পশু বা বনের পশু নয় – মনের পশুকে বলি দেওয়াটা ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু হায় ! আমরা কি মহাপুরুষদের শিক্ষা কোনোদিনও সঠিকভাবে গ্রহণ করেছি ? সেগুলিকে তো আমরা ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’– নিজের মতো তৈরী করে নিয়েছি। এইজন্যেই তো স্থান-কাল-পাত্রভেদে ধর্মমত ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্নতা এসেছে অর্থাৎ এককথায় সব গোলমাল হয়ে গেছে। মহাপুরুষগণ (ঈশ্বরের আদিষ্ট মানবগণ) বারবার শরীরধারণ করে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের মহিমার কথা, পরমেশ্বরকে প্রসন্ন করার উপায়ের কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন – কিন্তু আমরা বারবারই তাদেরকে আহত করেছি, নিহত করেছি অথবা প্রচন্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাঁদেরকে এতো বিরক্ত করেছি যে, তাঁরা অকালে শরীর ছেড়ে দিয়ে পুনরায় চিন্ময়লোকে ফিরে গিয়ে চিন্ময়সত্ত্বায় মিশে গেছেন !
বারবার তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার কারনটা কি বলুন তো ? কারণটা বললেন গুরুমহারাজ – ” পৃথিবীগ্রহটাই এখন কয়েকশো কোটি বছরের নবীন অবস্থায় রয়েছে। এখানকার সর্বোন্নত জীব মানুষ মাত্র কয়েক কোটি বছর হোলো আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে এখানকার মানুষের গড় সাধারণ মানসিকতা এখনও শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। উনি বললেন – ” পৃথিবী গ্রহের মানব যেন এখন হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় থেকে সবে উঠে দাঁড়াতে শিখছে। তাও এটা সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন মহাপুরুষদের শরীর ধারণের ফলেই !”
যাইহোক, এসব কথা থাক্ ! আমরা আবার এখন ফিরে যাই গুরুমহারাজ তাঁর “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে পরবর্তী পরিচ্ছেদে কি বলেছেন সেই কথায়। পরমপ্রিয় গুরুজী উপাসনার ভিন্ন ভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এই পরিচ্ছেদে উনি ‘শব্দ উপাসনা’ বা ‘নাম উপাসনা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ ! এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় হোলো ‘শব্দ উপাসনা’ বা ‘নাম উপাসনা’ ! শব্দের উৎপত্তি ও শব্দের তাৎপর্য নিয়ে কিঞ্চিৎ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন৷ চৈতন্য হোলো মহাকারণ, আদি পরাশক্তি বা ব্রহ্মশক্তি ! ঐ পরাবাক্-রূপ আদিশক্তি বিশ্বচরাচরে সর্বভূতে বিদ্যমান। বিশ্বসংসাররূপে সমস্তকিছুই ঐ মহাশক্তির স্বরূপ বা পরিণাম। এই বিশ্বসংসার প্রকাশ হবার পূর্বে অস্ফুটভাবে (যা) পরাবাকময় কারণরূপে বিদ্যমান থাকে। (এই মহাশক্তি) অস্ফুট অবস্থা হোতে স্ফুট অবস্থায় প্রকাশিত হয় সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মাধ্যমে। এই ব্যক্তশক্তিই ঈশ্বর, হিরণ্যগর্ভ ও বিরাটরূপে প্রকাশিত। মহাকারণ অবস্থা হোতে স্ফুট ব্রহ্ম বা প্রণব অভিব্যক্ত হয়ে স্থূল বিশ্বসংসাররূপে প্রতিভাত – এটাই হোলো শব্দব্রহ্ম বা প্রণবতত্ত্ব ! উপনিষদে এটা উদ্গীত নামে কথিত।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের উপরিউক্ত কথাগুলি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার সাধ্য আমার নাই। তবু আমাদের ধারণা অনুযায়ী একটু বিস্তৃত করার চেষ্টা করা যায়। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” চৈতন্য হোলো মহাকারণ।” এটাই আদিশক্তি, পরাশক্তি বা ব্রহ্মশক্তি ! এটিই পরাবাক্ এবং যা সর্বভূতে বিদ্যমান। এই মহাশক্তিরই স্বরূপ বা পরিণাম হোলো এই বিশ্বসংসারের সমস্ত কিছু ! এইজন্যেই বলা হয়েছে – ‘ব্রহ্ম বিভুতে ওতপ্রোত এবং অণুতে অনুস্যূত !’ তার মানে হোচ্ছে এই বিশ্বসংসারের সমস্ত কিছুর মধ্যে যেহেতু জীবকুলেরাও রয়েছে – তাই জীবশ্রেষ্ঠ হিসাবে আমরা মানুষেরাও সেই মহাশক্তির-ই স্বরূপ বা তার পরিণাম। এইজন্যেই অন্যত্র বলা হয়েছে “জীব ব্রহ্মৈব নাপরঃ”!– ঠিক আছে, এসব না হয় বোঝা গেল – কিন্তু আমরাও স্বরূপতঃ যদি সেই মহাশক্তির প্রকাশ হয়ে থাকি_ তাহলে আমাদের মধ্যে তার প্রকাশ ঘটছে না কেন ? এর উত্তর হোলো – ‘আমরা চাইছি না, তাই প্রকাশ ঘটছে না !’
কেন একথা বলা হোলো ? এর কারণ আমাদের মতোই অষ্টঅঙ্গবিশিষ্ট বেশকিছু মানুষ এই বিশ্বসংসারেই শরীর ধারণ করে নিজেদের জীবনে ঐ মহাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তাঁরা যখন পেরেছিলেন – তখন আমরা পারছি না কেন ? পারছি না তার কারণ, আমাদের প্রচেষ্টার অভাব ! তাঁদের প্রচেষ্টা ছিল – তাঁদের সমগ্র জীবন পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় কি ভীষণ এবং তীব্র সাধনা ছিল ঐ সকল মহাজন-মহাপুরুষদের ! আমাদের সেই সাধন কই ? আমাদের ভোগবাসনার জগৎ ছেড়ে ত্যাগের জগতে প্রবেশের প্রচেষ্টা কই ? এই জন্যেই তো আমাদের এতো ভোগান্তি ! মহামানবদের শিক্ষাগ্রহণ না করা, তাঁদের জীবনাদর্শকে অনুসরণ না করার জন্যই আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষদের যত দুর্দশা, দুরাবস্থা ! যে মুহূর্তে আমরা তাঁদের শিক্ষানুযায়ী আমাদের বাসনার মোড় বিপরীতমুখী করতে পারবো – সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদের মধ্যে সেই মহাশক্তির প্রকাশ ঘটতে থাকবে এবং আমরাও বোধ করতে পারবো যে, আমরাও স্বরূপতঃ সেই মহাশক্তির প্রকাশ !!