শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ কথা (কথিত ও লিখিত) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন আলোচনা করছিলাম গুরুজীর কথা অনুযায়ী ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’ নিয়ে। সমস্ত ধর্মমতের অনুসারীরাই ‘নাম’ উপাসনা বা ‘শব্দ’ উপাসনা করে থাকে। কেউ কেউ ঘরের কোণে নীরবে, কেউ মাইক লাগিয়ে সজোরে, কেউ খোল-করতাল-ঢাক-ঢোল-সানাই ইত্যাদি বাদ্য সহকারে, আবার কেউ হয়তো অন্য কোনোভাবে – কিন্তু যেভাবেই হোক প্রায় সকলেই ‘নাম’ উপাসনা করে থাকে। নিজ নিজ আরাধ্য বা ইষ্টের (প্রকৃত অর্থে সেই পরমেশ্বরের-ই) স্তব-স্তুতির দ্বারা অথবা শুধু-ই সেই পরমেশ্বরের (আল্লাহ, হরি, গড, কালী) অথবা বিভিন্ন নবী-পীর-পয়গম্বর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রবক্তা কোনো মহাত্মা-মহাপুরুষের ভজনা করা হয়। গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ার পর যে ‘মন্ত্রজপ উপাসনা’– এটাও একপ্রকার ‘নাম উপাসনা’-ই বলা চলে ! এইভাবে দেখা যায় – ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’ পৃথিবীর সকল ধর্মমতের লোকেরাই করে থাকে।
কিন্তু গুরুমহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) তাঁর আলোচনায় ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে একেবারে শব্দ (নাদ) সৃষ্টির উৎস থেকে আলোচনা শুরু করেছেন এবং কিভাবে এই ‘নাম উপাসনা’-র দ্বারাই সেই উৎসে ফিরে যাওয়া যায় – তার সাথেই আমাদের মিল করিয়ে দেবেন। তবে পূর্ব পূর্ব মহাজনগণও সেই একই কথা বলেছেন যে “যো- সো করে ঈশ্বরকে (গুরুরূপী ঈশ্বরকে) প্রসন্ন করাই সমস্ত উপাসনার উদ্দেশ্য !” আবার বৈষ্ণব মহাজনের কথায় রয়েছে – “এই হরিনাম নয় রে – আর হরিনাম আছে। এই হরিনাম নিয়ে যায় সেই হরিনামের কাছে !” এইভাবে নিশ্চয়ই স্থূল ‘নাম উপাসনা’র সাথে সূক্ষ্ম বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ‘নাম উপাসনা’র যে যোগ রয়েছে তা বিভিন্ন পরম্পরার মহাজনগণ বলে গেছেন – সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
তবে আমাদের (সাধারন মানুষদের) একটা স্বভাব রয়েছে – মহাপুরুষদের মূল শিক্ষা গ্রহণ না করে, আমার মনের মতো করে তার কিছুটাকে গ্রহণ করা ! আর এই সুযোগটাই নেয় যেকোনো পরম্পরার পরবর্তীজনেরা ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – কোনো আধ্যাত্মিক পরম্পরায় (অবশ্য কথাটা রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, সামাজিক যে কোনো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) শক্তি তিন generation পর্যন্ত কার্যকরী থাকে, তারপরে তা ফিকে হোতে শুরু করে এবং কমতে কমতে seventh generation-এর পরে এসে তা একেবারে Zero হয়ে যায়। ফলে কি হয়, সেইসব পরম্পরার গুরুরা বা ধর্মীয় নেতারা সাধারণ মানুষদেরকে তাদের মনের মতো করে কথা বলে বা শিক্ষা দেয়, মহাপুরুষদের কথাগুলির ব্যাখ্যা করে – আর সমকালীন মানুষ এদের কথাগুলোকেই অভ্রান্ত বলে মনে করে। এইভাবেই দেবতার চেয়ে পুরোহিত-পান্ডা-তান্ত্রিক-জ্যোতিষীরা মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, আল্লাহর চেয়ে মোল্লার কথা অধিক গ্রহণীয় হয়ে ওঠে, যীশুর কথা অপেক্ষা পোপ-বিশপ-ফাদারদের কথাই মানুষ মেনে চলে।
এইগুলিকেই বলা হয় ‘ধর্মের গ্লানি’ ! আর ধর্মের এইসব গ্লানি দূর করার জন্যই যুগে যুগে ঈশ্বরের অবতরণ হয় বা কোনো না কোনো মহাপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। ঈশ্বরের অবতরণ হোলে – সেই অবতারই যুগপুরুষ হিসাবে বা সেই যুগের পথপ্রদর্শক হিসাবে বহুকাল ধরে মানুষের মনোজগতের রয়ে যান। সেই যুগপুরুষের শিক্ষা-ই সেই যুগের মানুষের জন্য সবচাইতে কার্যকরী ! তাঁকে প্রসন্ন করতে পারলেই বহুজন্মের সাধনার ফল একজন্মেই লাভ করা যায় !
যাইহোক, আমরা এসব কথা ছেড়ে গুরুমহারাজ ‘নাম উপাসনা’ সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন – সেই দিকে দৃষ্টিপাত করি !
গুরুজী বলেছেন – “এই শব্দ (নাদ বা প্রণব) হোতেই মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্তাদি অন্তঃকরণ, পঞ্চতন্মাত্রা, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চভূত ও পঞ্চপ্রাণ সংযোগে বা সহযোগে এই স্থূল, সীমিত, খন্ডিত দৃশ্যমান জগৎ প্রতিভাসিত হচ্ছে !” সুতরাং এটা বোঝা গেল যে, সৃষ্টির শুরুতে যে নাদ বা পরাবাক প্রণব উদ্গীত হয়েছিল – সেই নাদ-ই হোলো মানবের সমস্ত কিছুর উৎস, আর যার সহায়তায় মানবের কাছে এই জগৎ (খন্ড রূপে) পরিদৃশ্যমান হয়ে থাকে। এরপর গুরুমহারাজ বললেন – “ঐ পরাবাকময় চৈতন্যই চিত্ত, মন, বুদ্ধি ও অহংকাররূপ অন্তঃকরণের কারণস্বরূপ ! পঞ্চভূত এবং পঞ্চপ্রাণেন্দ্রিয় সকলের মধ্যে শব্দের (নাদের) সূক্ষ্মশক্তি প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান। সূক্ষ্ম আকাশতত্ত্ব ও সূক্ষ্ম বায়ুতত্ত্বের সংযোগে এটা স্থূল শব্দরূপে মানবদেহের কন্ঠে প্রকাশিত। সেইহেতু শব্দের (নাদের) ঐ সূক্ষ্মশক্তি মানবজীবনের সমস্ত কিছুর ভিতর এবং বাইরে সর্বত্র ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান।”
গুরুমহারাজের উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, আমরা যেটাকে ‘শব্দ’ বলে জানি, সেটি হোলো স্থূল শব্দ। গুরুমহারাজ একে বলেছিলেন Noise, যদিও ‘শব্দ’ কথাটির ইংরাজী প্রতিশব্দ Sound ! আর মূল যে শব্দ বা আদিশব্দ – এটাই ‘নাদ’, প্রণব বা পরাবাকরূপ চৈতন্য _গুরূ মহারাজ এর ইংরেজি করেছিলেন tune ! যার সূক্ষ্মশক্তি বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শক্তি দ্বারাই এই জগতের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে, এতে ধৃত রয়েছে এবং আবার এতেই লয়প্রাপ্ত হচ্ছে ! উপনিষদে কেন শব্দকেই (নাদ) ব্রহ্ম বলা হয়েছে, তার কারন আমরা জানতে পারলাম। কারণ আমরা জানি – যে ব্রহ্মই সমস্ত কিছুতে অনুস্যূত ও ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে। গুরুমহারাজের কথা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, আদিশব্দ – প্রণব বা পরাবাকময় চৈতন্য শক্তিই সমস্ত কিছুতে ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে – সেইজন্যেই বলা হয়েছে – “শব্দই ব্রহ্ম” !
এরপর গুরুমহারাজ বলছেন – “এই শব্দের (স্থূলশব্দ) মাধ্যমেই মহাকরণরূপ পরাবাকময় অনাদি চৈতন্যের অনুভব হয়ে থাকে। এই স্থূলশব্দকে ‘মন্ত্র’ বলা হয়। চৈতন্যযুক্ত শব্দই ‘মন্ত্র’ ! ঐ পরাবাকময় আদি শব্দই বিশ্বের সুর বা আদিকারণ। আর ঐ উদ্গীতই সমস্ত জীবজগতের সুর ও ভাষারূপে প্রকাশিত। চৈতন্যময় পরাবাক্ শব্দই সমগ্র বিশ্বের মূল আধার।”