শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা আগের দিন ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’ নিয়ে গুরুমহারাজ তাঁর ‘সহজতা ও প্রেম’ গ্রন্থে এবং অন্যত্র যেসব কথা বলেছিলেন_ সেইসব আলোচনায় ছিলাম। আমরা দেখেছিলাম যে, সকল শব্দের উৎস হোলো পরাবাকময় চৈতন্য বা প্রণব। এবার আমরা দেখবো প্রণব নিয়ে গুরুমহারাজ আরো কি বলেছেন। উনি বলেছেন – ” ঐ পরাবাক্-ময় শব্দই বেদের উদ্গীত বা প্রণব। ব্যাকরণগত প্রণব শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে – প্রনু+অ(ণে); ‘প্রকর্ষণ নিয়তে স্তুয়তে অনেন ইতি প্রণব’– অর্থাৎ যার দ্বারা প্রকর্ষণের সঙ্গে বিশেষরূপে স্তবন করা যায় – তাই প্রণব। পরমেশ্বরের প্রকাশ এই বিশ্বসংসার। আদি পরাবাক ধ্বনি প্রথম উদ্গীত হয় পরমাত্মা হোতে। সেইজন্য পরমেশ্বরের বচনই প্রণব।” সুতরাং এটা বোঝা গেল যে, সেই পরমাত্মা পরমেশ্বরের প্রকাশ-রূপ বা বচন-রূপ হোলো পরাবাকময় চৈতন্য বা প্রণব। এই সমগ্র বিশ্বসংসার যা দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে, যাতে বিধৃত রয়েছে এবং যাতে লয়প্রাপ্ত হোচ্ছে। এই সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার – একটা continuous process, সবসময় হয়ে চলেছে। সুদূর অতীতে কোনো একদিন এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টি হয়েছিল –এখন স্থিতিকাল চলছে – আবার অনন্ত কোটি বছর পরে কোনো একদিন সবকিছু মহাপ্রলয় হয়ে যাবে – এমনটা নয় কিন্তু ! এই পৃথিবীগ্রহের নিরিখে ব্যাপারটা কিছুটা ঐরকম, কিন্তু সমগ্র মহাবিশ্বের নিরিখে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রমন্ডল অথবা সেই সব নক্ষত্রমন্ডলের কোনো গ্রহ তৈরি হোচ্ছে, কিছুকাল স্থায়িত্বলাভ করছে আবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যাইহোক, প্রণব নিয়ে গুরুমহারাজ কি বলছেন তা-ই শোনা যাক ! উনি এরপর বললেন – ” পরমাত্মা অনামী, তা হোলেও স্থূলজগৎ প্রকাশের পূর্বে পরাবাক্ আদি ধ্বনিতে এর প্রথম প্রকাশ ! তাই অনামী হয়েও তার নাম আছে, আর সে নাম প্রথম প্রণব-রূপ ! যা জড় বা বিশ্বরূপে আমরা দেখছি, তা পরমেশ্বরের চৈতন্যময়তারই প্রকাশ।” তাহলে আমরা এটা বুঝতে পারলাম যে, পরমাত্মার কোনো নাম বা উপাধি নাই ঠিকই, কিন্তু তাঁর প্রথম প্রকাশ নামযুক্ত – আর সেটাই হোলো প্রণব। তাছাড়া আমরা এটাও জানলাম যে, শুধু জীবজগৎ-ই নয়, এই বিশ্বসংসাররূপে বা জড়জগৎরূপে যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান – তা পরমাত্মা পরমেশ্বরের চৈতন্যময়তার-ই প্রকাশ ! অর্থাৎ আমরা যা ‘জড়’ বা অচেতন বলে মনে করি – তাও চৈতন্যময় ! সত্যিই তো পদার্থবিজ্ঞান দ্বারা এই সত্য সকলের কাছেই আজকে প্রমাণিত যে, জড়-ও চৈতন্যময় – কারণ প্রতিটি বস্তুর প্রতিটি পরমাণুর অভ্যন্তরস্থ কণাগুলি প্রচন্ড গতিশীল ! বস্তুর আবদ্ধ শক্তিতে আপাত স্থিতিশীল কিন্তু অভ্যন্তরে গতিশীল কণার সমাহার রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিন শক্তি, চুম্বকীয় শক্তি, স্থৈতিক শক্তি, গতিয়শক্তি ইত্যাদি শক্তির ভান্ডার।
গুরুমহারাজ এই ব্যাপারে বলেছেন – ” পদার্থের অতি ক্ষুদ্র অণুকণাগুলি বৃহৎ শক্তিতরঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কণাগুলি অপরিমেয় শক্তিতরঙ্গে মিশে শক্তিতে রূপান্তরিত হোচ্ছে, আবার কণিকায় পরিণত হোচ্ছে। এইভাবে অনন্ত নীহারিকাপুঞ্জ বিশ্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে রূপান্তরের কাজ চলেছে।” এখানেই গুরুমহারাজ অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের (particle/dynamics) ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যে কোনো পদার্থের পরমাণুকে ভাঙলে যে অপরিমিত শক্তি নিঃসৃত হয় – তা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির যে বৃহৎ শক্তিতরঙ্গ সদাসর্বদা বিরাজমান – তাতেই মিশে যাচ্ছে ! মহাবিশ্বজগতে এইভাবেই প্রতিনিয়তই একসাথে রূপান্তর-সকল অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সংঘটিত হয়ে চলেছে।
এরপর গুরুমহারাজ বললেন – ” অনাদিকাল হোতে প্রণব জড়জগৎ বা বিশ্বরূপে প্রকাশিত হচ্ছে !” সেই পরম চৈতন্যময় পরাবাক্ বা আদিশব্দ (নাদ)-ই অনাদিকাল থেকে পঞ্চভূত সমন্বিত জড়জগৎ বা বিশ্বরূপে প্রকাশিত। অন্যত্র গুরুমহারাজ স্থূল-সূক্ষ্ম ও কারণের প্রকাশ বোঝাতে বলেছিলেন __ বিশ্ব, তেজস্ ও প্রাজ্ঞ বা বিরাট, হিরণ্যগর্ভ ও ঈশ্বর ! তাহলে সেই চৈতন্যময় পরাবাক্ বা প্রণবের স্থূলরূপ-ই হোলো ‘বিশ্ব’ বা ‘বিরাট’ ! যাইহোক, এবার গুরুমহারাজ আলোচনা করেছেন – আমাদের মতো সাধারন মানুষ প্রণব নিয়ে কিরূপ ধারণা করি – সেই ব্যাপারে ! উনি বলেছেন – ” সাধারণতঃ সকলে ‘প্রণব’-কে বুঝে থাকেন বা বুঝাতে থাকেন এইরূপে যে, প্রণব – ‘অ’ – ‘উ’ – ও ‘ম’ -এর সমষ্টি ! ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ইত্যাদি নানারকমভাবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। বাস্তবিক একে ব্যাকরণের দ্বারা বিশ্লেষণ করা যায় না। স্বরূপতঃ এ এমন এক ধ্বনি যা সম্পূর্ণ যোগলব্ধ। যোগী বা সাধক ভিন্ন অন্য কেউ এটা অনুভব করতে পারে না। একমাত্র যোগলব্ধ আত্ম-অনুভূতির দ্বারা প্রত্যেকেরই এটা উপলব্ধি হোতে পারে।”
প্রিয় পাঠক ! এবার আর কি বলবেন ? গুরুজীর এই কথার পর তো আর কথা হয় না। কারণ প্রণবতত্ত্ব তো যোগলব্ধ ব্যাপার ! যোগের গভীরে, সাধনার দ্বারাই প্রণবতত্ত্ব জানা যায়, প্রণবধ্বনি (নাদ) শোনাও যায় এবং তা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করতে পারে। তাহলে আসুন – আমরা আজ থেকেই প্রণবধ্বনি নিজের জীবনে উপলব্ধি করার কাজে ব্রতী হই, আমাদের এই জীবন ধন্য করি।
যাই হোক, গুরুমহারাজ এরপর বললেন – ” বাক্য দ্বারা এই প্রণবধ্বনিকে প্রকাশ করা যায় না, লিখে বা সংকেত দ্বারাও এ অব্যক্ত থাকে। কারণ এ বর্ণনাত্মক ধ্বনি নয় বা কোনো ভৌতিক পদার্থের সংঘাত সৃষ্ট কোনো ধ্বনি নয়। এ একান্ত যোগলব্ধ অনুভূতি ! সুতরাং প্রণব হচ্ছে চিন্ময়, আর যিনি এই প্রণব অনুভব করেন – তিনিও চিন্ময়।”