শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন গুরুমহারাজ বর্ণিত ‘উপাসনা’ বিষয়ে কথা বলছিলাম। গুরুমহারাজ এখন আলোচনা করছিলেন — ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’ নিয়ে। “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে উনি এই ব্যাপারে যা বলেছিলেন সেইসব কথাই বলা হচ্ছিলো। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ …. ঐ পরাবাক্ আদিশব্দই বোধ, ইচ্ছা ও ক্রিয়া – এই ত্রিগুণ আশ্রয়ে বিশ্বজগতের যাবতীয় প্রকাশের কারণ ! সেহেতু চৈতন্যময় ধ্বনি (পরাবাক্ বা উদ্গীত) বিশ্বসংসারের সার বা মূল। প্রণব ঐ মহাশক্তি বা মহাকাল। স্থূলদেশে (তা-ই) ছন্দবদ্ধ সুর ও ভাষারূপে প্রকাশিত !”
প্রিয় পাঠক ! গুরুমহারাজ যেন একটা নতুন কিছু বললেন,– অবশ্য তাঁর কথা আমাদের কাছে সবই নতুনের ন্যায়। আমরা এতোকাল জানতাম যে, ত্রিগুণ প্রপঞ্চ অর্থাৎ এই জগৎসংসার স্বত্ত্ব, রজঃ ও তমগুণ দ্বারা বিধৃত। কিন্তু গুরুমহারাজ বললেন – বোধ, ইচ্ছা ও ক্রিয়া – এই তিনগুণ আশ্রয় করে জগতে সবকিছুই প্রকাশমান। তার মানেটা হোলো – ‘ক্রিয়া’-টা স্থূল বা তম:, ‘ইচ্ছা’-টা সূক্ষ্ম বা রজ: এবং ‘বোধ’ হল কারণরূপ যা সত্ত্বগুণের প্রকাশ ! প্রণবকে মহাশক্তি বা মহাকালও বলা হয়েছে ! আর জীবজগতের যত ভাষা, প্রকৃতির যত সুর-ছন্দ-তাল – সে সবই প্রণবের-ই স্থূলরূপ। এবার গুরুমহারাজ বলেছেন – “এই প্রণবের ব্যক্ত গতিশীলতার যে অবস্থা – তাই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপে সত্ত্ব, রজঃ ও তম:গুণের প্রবাহ দ্বারা বিশ্বচরাচরে চঞ্চলভাবে আবর্তিত হোচ্ছে। কিন্তু সর্বতোভাবে এই আবর্তের ঊর্ধ্বে ব্রহ্ম বা পরতত্ত্ব (সম্পূর্ণ তত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব) নিস্তরঙ্গ গুণাতীত অখন্ড সত্তা। এই ব্যক্ত চরাচর বিশ্বসংসার ব্যক্ত শব্দশক্তির গুণের দ্বারা সীমিত। সেইজন্য কারণময় মহাশক্তির পরিণাম হলো জগৎ।” গুরুমহারাজ এবার সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃগুণের কথা উল্লেখ করলেন – এই তিনের প্রবাহ দ্বারাই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সদাসর্বদা হয়ে চলেছে এই বিশ্বচরাচরে, আর এই সমস্ত-ই প্রণবের ব্যক্ত গতিশীল অবস্থা ! ব্রহ্ম বা পরতত্ত্ব অথবা সম্পূর্ণতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তা গুণাতীত, নিস্তরঙ্গ, অখণ্ড সত্তা ! সেই অখণ্ড, অব্যক্ত শক্তির ব্যক্ত শব্দশক্তি থেকে এই বিশ্বচরাচর ব্যক্ত।
এরপর গুরুমহারাজ এই বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরও বলেছেন – ” পরাবাকময় চৈতন্য ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপে গুণময়লীলা বা ক্রিয়াশীলতা। তাই পরাবাকের অবরোহ গতিই হোলো বিশ্বসৃষ্টি যা পরা-পশ্যন্তি-মধ্যমা ও বৈখরীরূপে প্রকাশিত ও প্রতিভাত, আর ঐ পরাবাকের আরোহ গতিই হোলো প্রলয় – যা বৈখরী, মধ্যমা, পশ্যন্তি হয়ে পরাবাকে বিলীন হয়ে যায়৷”
প্রিয় পাঠক ! তাহলে বোঝা গেল ঈশ্বরের গুণময় লীলা হোচ্ছে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়, যা পরবাক চৈতন্যময় সত্তা বা প্রণবেরই ক্রিয়াশীলতা। সেই পরাবাক (চৈতন্যময় সত্তা) প্রণবের অবরোহ বা নিম্নমুখী গতির দ্বারাই এই বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি। সেই পরাবাকের (প্রণব বা নাদ) ব্যক্ত অবস্থায় চারটি রূপ রয়েছে, যেগুলি হোলো – পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা ও বৈখরী। পরাবাকের অবরোহ গতির ক্রম হল পরা-> পশ্যন্তি-> মধ্যমা-> বৈখরী। আবার যখন এই পরাবাক বা চৈতন্যময় সত্ত্বা-ই আরোহ গতি প্রাপ্ত হয় তখন বৈখরী-> মধ্যমা-> পশ্যন্তি-> পরা – এই ক্রমে প্রলয় সংঘটিত হয়।
এরপরে গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – শব্দের এই যে আরোহ ক্রমগতি – এটাই হোলো নাম উপাসনা বা শব্দ উপাসনার রহস্য ! এই প্রণব উপাসনা – শব্দ সাধনা, নাম সাধনা প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দেশ, কাল, পাত্রে প্রচারিত !”
পাঠককুল ! বুঝতে পারলেন তো_ শব্দ উপাসনা বা নাম উপাসনার আসল রহস্যটা ! ‘বৈখরী’ মানে হোলো স্থূল শব্দ অর্থাৎ নানারকমের আওয়াজ – পশু-পাখিসহ মানুষের ভাষা ইত্যাদি। ‘মধ্যমা’ হোলো মুখে শব্দ না করে কোনো কিছুর মাধ্যমে মনের ভাব বোঝানো। আকারে-ইঙ্গিতে বা অন্য কোনোভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা। ‘পশ্যন্তি’ হোলো মনে মনে ভাবা বা বলা। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এটা দেখেছে যে, মানুষ মনে মনে চিন্তা করলেও ‘শব্দ’ হয়, তবে তা সূক্ষ্ম অবস্থার শব্দ ! ‘পশ্যন্তি’ অবস্থায় শব্দ প্রেরণের জন্য দূরত্বটা তখন আর কোনো factor হয় না, সময়ের ব্যবধানও প্রায় থাকে না বললেই হয় ; থাকলেও তা এতো সামান্য যে মানুষের বুদ্ধির অগোচর ! এরপরের ধাপ হোলো ‘পরা’৷ ‘পরা’-ই পরাবাকের সাথে সাক্ষাৎ সম্পর্কযুক্ত, ‘পরা’– বাক-ই ‘পরাবাক’ বা চৈতন্যসত্তাকে ছুঁয়ে থাকতে পারে ! যাইহোক, এই দুর্জ্ঞেয় জগত রহস্য, জীবন রহস্য, সৃষ্টি রহস্য গুরু মহারাজ সহজভাবে না জানালেআমরা কি জানতে পারতাম !! তাই আমরা সর্বোতভাবে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ! তাছাড়া এইটুকু প্রকাশ করা ছাড়া_ তাঁর জন্য আমরা আর কি-ই বা করতে পারি ! এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টিরহস্য এবং তার সাথে সাথে প্রলয়ের রহস্য কত সুন্দর করে আমাদেরকে উনি বুঝিয়ে বলেছেন!
কিন্তু গুরুমহারাজের এবারের যুগধর্ম প্রচারের অন্যতম ভাব ছিল “বাউল ভাব”! আর বাউল বলে – “ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড”- তত্ত্বের কথা ! তাই আগামী আলোচনায় এই মহাজাগতিক সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের theory কিভাবে দেহভাণ্ডেও ক্রিয়াশীল – সেই রহস্য আমরা গুরুমহারাজের কথা থেকে অবগত হবো। আজ এই পর্যন্তই থাক।৷
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ