শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। এখন আমরা ছিলাম ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’-র কথায়।গুরুমহারাজের কাছ থেকে অর্থাৎ তাঁর কথা থেকে আমরা ব্যক্ত চৈতন্যসত্তা পরাবাক প্রণবের উৎপত্তি এবং এর অবরোহ বা আরোহ অবস্থাই যে বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় রূপ – তা জেনেছি। এখন ‘ভান্ডে ব্রহ্মান্ড’- তত্ত্বের স্বপক্ষে গুরুমহারাজ কি বলেছেন তা দেখা যাক্।
উনি বলেছেন – ” বিশ্বচরাচর ব্রহ্মান্ডের সঙ্গে আমাদের দেহরূপ এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড একই সূত্রে ওতপ্রোত। এই দেহরূপ ব্রহ্মান্ডেও ঐরূপ পরাবাকময় শব্দের রহস্যময় অবরোহ-ক্রম ও আরোহ-ক্রম বিরাজমান বা বিদ্যমান। দেহভান্ডে ইড়া, পিঙ্গলার মাধ্যমে ঐ অবরোহগতি ক্রিয়াশীল প্রতিটি মানবে। আরোহ-ক্রম গতি সুষুম্মানাড়ীকে মাধ্যম করে ক্রীয়াশীল হয়। কিন্তু সাধারণতঃ প্রত্যেক দেহে এই নাড়ী সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান, অর্থাৎ ক্রিয়াশীল থাকে না। সদ্গুরুর সংস্পর্শে ও সাধনায় এর উন্মেষ ঘটে থাকে এবং সুপ্ত স্তরগুলি ক্রিয়াশীল হয়।”
তাহলে এটাই বোঝা গেল যে, যেইরকম সমগ্র বিশ্বচরাচরে বা ব্রহ্মান্ডে পরাবাকময় শব্দের অবরোহ ও আরোহক্রমে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সংঘটিত হয়ে থাকে – দেহরূপ ভান্ডেও এই একই ক্রিয়া ক্ষুদ্র আকারে ঘটে থাকে। দেহভান্ডে ঐ শক্তির অবরোহ-ক্রম শরীরের প্রধান তিনটি নাড়ীর ইড়া ও পিঙ্গলার মাধ্যমে এবং আরোহ-ক্রম সুষুম্নানাড়ীর মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হয়। আমাদের ন্যায় সাধারণ মানবের ক্ষেত্রে ঐ মহাশক্তির অবরোহ-ক্রমটাই ক্রিয়াশীল থাকে কিন্তু সুষুম্নানাড়ী সুপ্ত অবস্থায় থাকার জন্য আরোহ-ক্রম ক্রিয়াশীল হয় না। একমাত্র সদ্গুরুর আশ্রিত সাধকের (সদ্গুরুর সংযোগযুক্ত মানুষেরা নয় – সম্পর্ক বা সম্বন্ধযুক্ত মানুষেরা) অর্থাৎ যার সদ্গুরুর সংস্পর্শ লাভ হয়েছে এবং তার সাথে সাথে জীবনে সাধনাও রয়েছে, তাদেরই সুষুম্না নাড়ী খুলে যায়।
যাদের সুষুম্নাদ্বার খুলে গেছে তাদের সম্বন্ধে গুরুমহারাজ বললেন – ” মানব তখন আরোহ-ক্রম গতিদ্বারা পরমস্থিতি লাভ করে। এই পরাবাকময় প্রণবরূপ ঈশ্বর অন্তঃকরণ দ্বারা অনুভবগম্য এবং নাম-সাধনা বা শব্দ-সাধনার দ্বারা লভ্য !” তাহলে বোঝা গেল যে, একমাত্র সদ্গুরু আশ্রিত সাধকের সুষুম্মাদ্বার খুলে যায় এবং তখনই তার মধ্যে পরাবাকময় চৈতন্যশক্তির আরোহ গতি লাভ হয় এবং এই গতির দ্বারা সাধক পরমস্থিতি লাভ করতে পারে। ‘নাম সাধনা’ বা ‘শব্দ সাধনা’-র দ্বারাই ঐ ধরনের সাধকের পরাবাকময় চৈতন্যরূপ ঈশ্বরকে অনুভব বা উপলব্ধি করতে পারে।
এরপর গুরুমহারাজ বললেন – ” যা গুণাতীত তত্ত্ব এবং নিস্ত্রৈগুণ্য – তা বাক্য, মন, বুদ্ধি ও অহংকারের অতীত ! এই তত্ত্বকে মানব নির্বিকল্প সমাধি দ্বারা ‘বোধে বোধ’ করতে পারলেও বিশ্বে সংবাদ দেবার ব্যক্তিত্ব তার থাকে না। তা কেবল ‘বোধে বোধ’ হয়। যা লাভে – অলভ্য কিছু থাকে না, যার বোধে সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার সমাপ্তি, তাই অমৃততত্ত্ব। তুমি অমৃতের, অমৃত তোমার। তুমি অমৃতস্বরূপ ! তত্ত্বমসি !” এই কথাগুলির দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম – ত্রিগুণ সমন্বিত ব্যক্ত পরমচৈতন্য বা পরাবাকরূপ ঈশ্বরকে সাধনার দ্বারা অন্তঃকরণ দিয়ে অনুভব করা যায় বা উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু গুণাতীত তত্ত্বকে অর্থাৎ অব্যক্ত পরমচৈতন্যকে অন্তঃকরণ দ্বারা (অন্তঃকরণ চতুষ্টয় অর্থাৎ মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার) অনুভব বা উপলব্ধি করা যায় না। তাকে একমাত্র নির্বিকল্প সমাধির দ্বারাই ‘বোধে বোধ’ করা যায়।
এই পরমবোধ একবার হয়ে গেলে বা ‘বোধে বোধ’ হয়ে গেলে_ সাধকের আর চাওয়া-পাওয়া থাকে না, আর লাভ করার কিছু থাকে না। এটাই ‘বোধ’ হয় যে, ‘সে অমৃতস্বরূপ’! কিন্তু এই অবস্থায় সাধক পৌঁছালে, সে তার বোধের কথা জগৎকে বা বিশ্ববাসীকে জানাতে পারে না, কারণ তার জানানোর মতো ব্যক্তিত্ব-ই থাকে না ! তাহলে এখানে একটা জিজ্ঞাসা এসেই যাচ্ছে যে, তাহলে বেদে বা উপনিষদে যে সমস্ত সত্যদ্রষ্টারা “শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”- বলে যে পরমসত্যের কথা, পরমবোধের বলে কথা বলে গেছেন – তাহলে সেগুলি কি করে বললেন ? গুরুমহারাজ অন্যত্র (বিভিন্ন সিটিং-এ) যেসব কথা বলেছিলেন, তাতে করে আমরা এটাই বুঝতে পেরেছি যে, Ascending অর্থাৎ পার্থিব নিয়মাধীনে বা মহামায়ার অধীনে থাকা যে সমস্ত সাধকেরা জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার দ্বারা পরমসত্যের বোধ করতে চায় এবং একসময় তা লাভ করে – এখানে তাঁদের কথাই গুরুমহারাজ বলেছেন। এঁরা নির্বিকল্প সমাধি অবস্থা লাভ করলেও তা অন্যদের জানাতে পারেন না। কিন্তু যাঁরা descending অর্থাৎ যাঁদের অবতরণ হয় বা যাঁরা প্লাস ওয়ার্ল্ডের লোক – তাঁরা এই পৃথিবীতে শরীরগ্রহণ করেন, এখানকার মানুষের মতোই আচরণ করেন এবং যুগ-প্রয়োজনে তাঁরাও সাধনার দ্বারা (অনায়াসেই) নির্বিকল্প সমাধি অবস্থা প্রাপ্ত হ’ন। যুগে যুগে ‘বোধে’-র কথাগুলি তাঁরা-ই বলে যান_ নতুন নতুন ভাবে – নতুন নতুন আঙ্গিকে !!