শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত এবং লিখিত) এখানে বলা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ, ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’ নিয়ে যে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেনআমরা ছিলাম সেইসব কথায়। গুরুমহারাজ সমাজের মানবের দুর্দশা দেখে খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন ! কারণ_ এতো মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করার পরেও, তাঁদের দ্বারা সহজ-সরল অধ্যাত্ম শিক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও মানুষ আজও নানান কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ! আর এইসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানবেরাই মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যে ঈশ্বরলাভ বা আত্মজ্ঞান লাভ সেটা ভুলে উপলক্ষ্যরূপ সংসারের ভোগবাসনায় মেতে রয়েছে ! এইজন্যেই গুরুমহারাজ ঐধরণের কুসংস্কারগ্রস্থ তথাকথিত উপাসনাকারীদের উদ্দেশ্যে বললেন – “….. তাঁরা বলতে থাকেন – ‘আমাদের এই নাম-ই একমাত্র ঈশ্বরের নাম আর এই নামেই একমাত্র ভজনা হয়, অন্য নামে তাঁর ভজনা হয় না’– কি ভয়ঙ্কর অজ্ঞতা ! অর্বাচীন লোকের এরূপ বাক্য মানবকে বিভ্রান্ত করে ৷ তাঁরা আরো বলে থাকেন – ‘তাদের সম্প্রদায়ের নাম ছাড়া অন্য নামে তাঁকে ডাকলে তাঁর সাড়া পাওয়া যাবে না। এক ঐ নামে তাঁকে উপাসনা করা ছাড়া অন্য নামে তাঁর আরাধনা করা উচিত নয়৷” পাঠকবৃন্দ !! গুরুমহারাজের এই ব্যথাভরা কথাগুলি কি অনুধাবন করলেন ?? আমরা প্রতিনিয়তই সমাজে এই সাংঘাতিক সমস্যার সম্মুখিন হই ! রাজনীতির নামে ধ্বংসলীলা, হানাহানি-মারামারি-রক্তপাত তো আছেই, কিন্তু ধর্মনীতির নামে এই যে সম্প্রদায়বুদ্ধি অর্থাৎ প্রত্যেকেই বলছে‘আমরা যে নামে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ডাকি, সেটাই শ্রেষ্ঠ’, অথবা ‘আমার সম্প্রদায়ের ধর্মশিক্ষা বা ধর্মাচরণের চেয়ে জগতের বাকিসব ধর্মমত বা ধর্মাচরণ নিকৃষ্ট’– বহুকাল থেকে এই ভাবনাগুলিও সমাজে কম রক্তপাত ঝরায়নি, কম মানুষে মানুষে বিভেদের-বিদ্বেষের বিষ ছড়ায়নি !
গুরুজী এই ধরনের ভাবনাচিন্তাকে বললেন ‘অজ্ঞতা’ এবং এই ধরনের ভবনাকারীদের উনি ‘অর্বাচীন’- এই বিশেষণে বিশেষিত করলেন ৷ এরূপটা কেন করলেন – তার ব্যাখ্যাও উনি পরক্ষণেই দিয়ে দিয়েছেন, কারন উনি এরপরে বলেছেন – ” এই ধরনের কথায় সাধারণ মানব বিভ্রান্ত হয়, আর অপরের কথায় বিভ্রান্ত সাধারণ মানবের আর তখন স্বাধীন যুক্তি-বুদ্ধি কাজ করে না – তারা যেন intoxicated অবস্থায় চলে যায় এবং ঐ ধরনের অর্বাচীন ধর্মীয় নেতাদের কথায়, ধর্মের নামে মানবতা-বিরোধী যেকোনো কাজ করে বসে। রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে এই ধরনের উন্মাদনা-ই বর্তমান মানব সমাজের একমাত্র বিভীষিকা, সংস্কৃতি-সভ্যতা-উন্নতির প্রধান শত্রু ! একমাত্র পরমেশ্বরের মহান ইচ্ছাতেই বর্তমান এই সংকট থেকে মানবসভ্যতা রক্ষা পেতে পারে, অন্যথায় মানব সমাজের ধ্বংস অনিবার্য ! অনবরত চলতে থাকা হানাহানি-মারামারি-রক্তপাত কখনোই বন্ধ হবার নয় !”
ঐ সমস্ত অর্বাচীন ভাবনা থেকে কিভাবে বেরোতে হয় সেই ভাবনাও গুরুমহারাজ আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। তাইতো উনি বললেন – “….. কিন্তু ভাবগ্রাহী ভগবান (পরমেশ্বর) সর্ব্বভাবেই সাড়া দেন। তিনি (পরমেশ্বর) প্রাণের আবেগ ও মনের আকুল প্রার্থনায় সবসময় সাড়া দেন।”
প্রিয় পাঠক ! সহজ-প্রেমিক-বাউলরাজ-যুগাবতার স্বামী পরমানন্দ কত সহজ সমাধান দিয়ে দিলেন – দেখলেন ?
‘প্রাণের আবেগ’ এবং ‘মনের আকুল প্রার্থনা’-য় সবসময়েই সেই পরমেশ্বর সাড়া দেন – এই কথাগুলি আত্মস্থ করতে পারলেই সমস্ত মতবিরোধের অবসান হয়ে যেতে পারে, সমস্ত ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট-মারামারি-হানাহানি থেমে যেতে পারে।৷
এরপর গুরুমহারাজ আমাদের মতো অর্বাচীন মানবসকলকে উদ্দেশ্য করে আরও সহজভাবে বললেন – ” প্রিয় আত্মন্ – তুমি নিজ ভাব অনুযায়ী তোমার প্রিয় নামটি আশ্রয় করো এবং সেই ভাব সহযোগে নামের দ্বারা তাঁকে অকপটভাবে ভজনা করো ! কারও প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ো না। তাঁর নাম কি কেবল একটি – আর কিছু নয় ? এই অনন্ত বিশ্ব যাঁর প্রকাশ, তিনি কি কোনো নামে আবদ্ধ ? তোমার যে নামটিতে নিষ্ঠা, তুমি সেই নামটিকে আশ্রয় করো – তিনি একই তত্ত্ব। নাম পরিবর্তন করলে কি তত্ত্বের পরিবর্তন হয় ?”
এইভাবেই গুরুমহারাজ ধরে ধরে যুক্তিসহকারে আমাদেরকে সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ সত্যিই তো – ‘নামে’ কি আসে যায় – এই অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তো তাঁরই(সেই পরমেশ্বরের) প্রকাশ ! তাই তিনি নির্দিষ্ট ‘নামে’ কি করে আবদ্ধ থাকতে পারেন ? তাঁর অনন্ত নাম – তাঁর মহিমা প্রকাশের ভঙ্গিমা (উপাসনা পদ্ধতি)-ও অনন্ত হোতে পারে – এতে আর বিচিত্র কি ?
পরমেশ্বর(আলাদা,হরি,রাম,কালী,গড–ইত্যাদি) কোনো নামে আবদ্ধ নয় – পরমেশ্বর হোলো তত্ত্ব ! তাই নাম পরিবর্তন হোলেও তত্ত্বতঃ তিনি একই থাকেন – এটাই সহজ সিদ্ধান্ত ! গুরুমহারাজ নাম নিয়ে ঝগড়ার ব্যাপারে আরো বললেন – ” অজ্ঞানী ভ্রান্ত ব্যক্তিরাই নাম নিয়ে ঝগড়া-বিবাহ ও কলহ করে৷ তুমি তত্ত্বমুখী হও। তুমি তোমার প্রিয় আকাঙ্খিত নামটি গ্রহণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে ভজনা করতে থাকো – তুমি তাঁকেই বোধ করবে।”
তাহলে বোঝা গেল যে, পরমেশ্বরের (আল্লাহ, রাম, কালী, গড ইত্যাদি) নাম নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে বা মারামারি করে অজ্ঞানী-ভ্রান্তরা ! আর যেসব সাধক বা উপাসক তত্ত্বমুখী হয়, তাঁর নিজ নিজ স্বভাব অনুযায়ী আকাঙ্খিত পরমেশ্বরের নাম গ্রহণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে ভজনা করতে থাকেন – তাঁরই আত্মসাক্ষাৎকার হয় – তিনিই ‘বোধে বোধ’ করেন।