শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ তাঁর স্বহস্ত রচিত “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে ‘সহজতা’ বিষয়ক কথা বলতে গিয়ে মানবজীবনে ‘উপাসনা’-র নানান দিক এবং উপাসনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন প্রকারের উপাসনা পদ্ধতি, বিশেষতঃ পৃথিবীর সমস্ত প্রকার ধর্মমতের অনুরাগীরা যে ‘নাম-উপাসনা’ করে থাকেন এবং এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ‘নাম’ নিয়ে পরস্পরে বিরোধ করেন –এগুলিকে উনি বলেছেন_’অজ্ঞতা’! আর এই অজ্ঞতা দূর করার জন্য ‘বোধে’-র কথা বলেছেন। বিভিন্ন প্রকারের মূর্তি বা সাকার উপাসনাও যে সেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের-ই উপাসনা – তাও উনি সুন্দরভাবে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। পরিশেষে উনি মূল কথা বলেছেন যে, মানুষ যতক্ষণ না আত্মতত্ত্বের বোধ বা ব্রহ্মতত্ত্বের বোধ (পরমেশ্বর তত্ত্বের বোধ) করছে – ততক্ষণ পর্যন্ত ধর্মাচরণের বা উপাসনার প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হবে না। আর উনি এটাও বলেছেন যে, একমাত্র নির্বিকল্প সমাধিতেই সেই ‘বোধে’ উপনীত হওয়া যায়।
এইবার উনি উক্ত গ্রন্থে পরম পুরুষার্থ ‘প্রেমে’-র সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। আমরা এখন ধীরে ধীরে সেইসব আলোচনায় প্রবেশ করব। তার আগে গুরুমহারাজের অন্য সময়ে বলা কিছু কথা এখানে একটু বলে নেয়া যাক্। গুরুমহারাজ বলেছিলেন – আমরা জাগতিকভাবে যাকে ‘প্রেম’ বলে থাকি তা ‘প্রকৃত প্রেম’ নয় – তা ‘প্রাকৃত প্রেম’ ! অপার্থিব বা অকৈতব প্রেম অথবা প্রত্যাশাবিহীন ভালোবাসা দিতে পারেন একমাত্র বোধি ব্যক্তিরা এবং ভগবান স্বয়ং – অর্থাৎ যখন যখন পৃথিবীতে ঈশ্বরের অবতরণ হয় তখন কতিপয় পূণ্যবান ব্যক্তি ভগবানের সরাসরি সংযোগে এসে সেই অপার্থিব প্রেমের কিছুটা হোলেও স্পর্শ পেয়ে থাকে। আর সাধকদের ক্ষেত্রে নির্বিকল্প সমাধিলাভ হোলে – তারপরেই তাঁর মধ্যে প্রকৃত প্রেমের স্ফূরণ ঘটে। তাই বলা হয়েছে – “জ্ঞানলাভের পরে প্রেম !”
তথাকথিত বৈষ্ণবদের যে কথায় কথায় কান্না, আর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা – এগুলি ভাব-বিকৃতি, এগুলিতে কখনোই প্রকৃত প্রেমের ছিটেফোঁটাও থাকে না ! ঐগুলি স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী সাময়িক আবেগবশতঃ ঘটে থাকে, এগুলির (স্থান-কাল-পাত্রের) যেকোনো একটি পাল্টালেই ঐসব আবেগের অবলুপ্তি ঘটে।
যাইহোক, আমরা আসছি গুরুমহারাজের কথায়, “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে গুরুজী ‘প্রেম’ বিষয়ে ভূমিকায় কি বলেছেন__ তা আগে দেখে নিই ! উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – সমাজ সুস্থ হবে এবং সমাজে শান্তি আসবে ও কল্যাণ সাধিত হবে তখনই, যখন ‘প্রেম’-কে আশ্রয় করে সমাজ বা মানবজাতি অগ্রসর হবে। প্রেমকে কেন্দ্র করে মানব সভ্যতা না গড়ে উঠলে মানব-সমাজের মঙ্গল বা কল্যাণ হওয়া খুবই দুরূহ। সমাজের সমস্ত অশান্তির মূলে হোলো প্রেমহীনতা ! প্রেমের উপর ভিত্তি করে মানবসমাজকে গড়তে হবে। যদি মানবজাতি ও সমাজকে উন্নত করতে চাও, তাহলে প্রেমের শিক্ষা দাও। মানুষের প্রথম শিক্ষা হলো – মানুষকে ভালোবাসা !”
গুরুমহারাজের উপরোক্ত কথাগুলি একেবারেই সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল। পাঠকবৃন্দের বুঝতে কোথাও কোনো গোলমাল হবার কথা নয় — তাই কথাগুলির আর পুনরুক্তি করতে চাই না। শুধু দুটো কথায় আর একবার সকলকে ভালোভাবে দৃষ্টি দিতে বলবো, তার মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে – “সমাজের সমস্ত অশান্তির মূলে হোলো প্রেমহীনতা” এবং “মানুষের প্রথম শিক্ষা হোলো মানুষকে ভালোবাসা।” তাহলে গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারলাম যে, সমাজের সমস্ত প্রকারের অশান্তির জন্য অর্থাৎ ধর্মীয় বিভেদ, রাজনৈতিক বিভেদ, বর্ণগত বিভেদ, জাতিগত বিভেদ, আবার খাদ্য নিয়ে বিরোধ, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিরোধ, নারী এবং সম্পদ-সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বিরোধ, অহংকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধ – ইত্যাদি সকল বিভেদ বা বিরোধের মূলে রয়েছে প্রেমহীনতা ! মানুষের হৃদয়ে একবার প্রেমভাব জাগ্রত হোলেই সমস্ত প্রকার বিরোধের অবসান হয়ে যেতে পারে।
এরপর গুরুমহারাজ যা বললেন তা মানবসমাজকে চমকে দেবার মতো কথা ! উনি বললেন – ” প্রেমহীন মানব জগতের বড় দুর্ঘটনা।” সমাজে প্রচলিত তিনটি কথা রয়েছে – ঘটনা, অঘটন এবং দূর্ঘটনা। ঘটনা এবং অঘটন পরস্পরের বিপরীতার্থক শব্দ এটা আমরা বুঝতে পারি। আর মানবজীবনে দুর্ঘটনা হোলো এমনই ঘটনা, যা আমরা এড়িয়ে চলতে চাই কিন্তু অকস্মাৎ এমনভাবে ঘটে যায় যে, কারো কিছু করার থাকে না এবং জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।
গুরুমহারাজ এইভাবেই ‘প্রেমহীন মানব’-কে সমাজের, তথা সমগ্র জগতের ক্ষেত্রে যেন ঐরূপ দুর্ঘটনাস্বরূপ ! তবে এখানে একটা কথা বলার আছে – প্রকৃতপক্ষে ‘প্রেমহীন মানব’ কি জগতে খুব বেশি রয়েছে ? কারণ অতি বড় নিষ্ঠুর ব্যক্তি, পেশাধারী খুনি – যারা হাসতে হাসতে মানুষকে হত্যা করতে পারে – তারাও কিন্তু তার সন্তানকে স্নেহ করে, চুমা খায়, তাদের সঙ্গে হেসে-খেলে সময় কাটাতে ভালবাসে ! তাহলে এরাও তো সম্পূর্ণভাবে প্রেমহীন নয় ! সেই অর্থে প্রকৃতপক্ষে ‘প্রেমহীন মানব’ যদি কোনো সমাজে থাকে – তাহলে সত্যিই তা জগতের পক্ষে দুর্ঘটনা বই কি !
আমরা জগতে ‘প্রেম’ এবং তার বিপরীতার্থক শব্দ ‘কাম’ – এই দুটো প্রায়ই শুনে থাকি। গুরুমহারাজ ও এইদুটো শব্দ নিয়ে কথা বলেছেন, উনি বললেন – ” প্রেমের মধ্যে দিয়ে আসে দেবতা-মহামানব, আর কামের মধ্যে দিয়ে আসে দানব – অসহজ পশু-মানব। প্রেমবোধ যার হোলো না, পরমাত্মার বোধ তার কেমন করে হবে !” প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এই যে গুরুমহারাজ ‘কাম’ এবং ‘প্রেমে’-র কথা উল্লেখ করলেন ! এটা যে শুধুই নর-নারীর প্রেম বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার প্রেমভাব বা কামভাব তা নয় ! সাধারণভাবে কথাগুলো শুনে এটাই মনে হোচ্ছে যে, নর-নারীর (স্বামী-স্ত্রীর) মধ্যে পারস্পরিক প্রেমভাব বিদ্যমান থাকলে, সেই পরিবারে দেব-স্বভাবের মানুষ জন্মাবে অথবা মহাত্মা-মহাপুরুষের জন্ম হবে। গুরুমহারাজ একবার তাঁর সিটিং-এ উপস্থিত মায়েদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন – “তোরা এক একজন ভালো ‘মা’ হয়ে ওঠ দেখি ! অনেক উন্নত soul শরীর নিতে চাইছে, কিন্তু উপযুক্ত গর্ভ না পাওয়ায় তা সম্ভব হোচ্ছে না !” বর্তমান পৃথিবীর যা অবস্থা – তাতে অনেক উন্নত মহাপুরুষগণের পৃথিবীতে শরীর গ্রহণের সময় এসেছে। নাহলে তো কামের মধ্যে দিয়ে আসা অসহজ পশুমানব বা দানবেরা পৃথিবীর কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতাকে অতিসত্বর বিনষ্ট করে ফেলবে !!
তাই সত্যি সত্যিই এখন সমাজে বেশি বেশি ভালো মায়ের প্রয়োজন। অবশ্যই তার সাথে সাথেই প্রেমিক পুরুষের‌ও প্রয়োজন রয়েছে। তবেই তো নর-নারীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং তাদের মধ্যে দিয়েই মানব সমাজে অনেক অধিক সংখ্যায় দেব-স্বভাবের মানুষ, মহাত্মা মহাপুরুষগণ জন্মগ্রহণ করবেন। মানবসমাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে__যা একান্ত প্রয়োজন।।