শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। উনি ওনার স্বহস্ত রচিত “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে ‘প্রেম’ বিষয়ে যে সমস্ত কথা মানবসমাজের উদ্দেশ্যে বলে গেছেন – আমাদের এখনকার আলোচনা সেইগুলি নিয়েই। যুগপুরুষ-যুগাবতার স্বামী পরমানন্দ যুগের প্রয়োজনে মানুষকে প্রেমের ব্যাখ্যা দিয়ে সতর্ক করেছেন, সত্য অবগত করিয়েছেন – এই সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ! এইবার গুরুমহারাজ পৃথিবীর সমস্ত ধর্মমতের উপাসনাকারীদের উদ্দেশ্য করে কি বলছেন শুনুন ! উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – চোখ বুজে করজোড়ে কি চাইছো ? ভগবান (ঈশ্বর, আল্লাহ, গড)? ভালবাসতে থাকো – তোমার অন্তরে প্রেমের স্রোত বইবে, আর ঐ প্রেমের প্রবাহ তোমায় পরমাত্মা-সাগরে পৌঁছে দেবে। সেইজন্য পথ–ভালোবাসা, সাধনা–প্রেম এবং লক্ষ্য–পরমাত্মা ! তোমার দৃষ্টিপথে যে পড়ে তাকে ভালবাসো।”
গুরুমহারাজ আমাদের চেতনাকে যেন চাবুক মারলেন! সত্যিই তো আমরা যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী (তা সে যে কোনো ধর্মমতেরই হই না কেন) – তারা তো একান্তে চোখবুজে করজোড়ে ঈশ্বরকেই চাই, তাঁর উদ্দেশ্যেই প্রার্থনা করি, মনে মনে ভেবে নিই যে, তিনি আমার কথা – আমার প্রার্থনা স্বকর্ণে শুনছেন ! কিন্তু গুরুমহারাজ আমাদেরকে সতর্ক করে দিলেন এই বলে যে,__ যার অন্তরে প্রেমের সঞ্চার হোলো না, প্রেমবোধ হোলো না – সে কি করে ঈশ্বর, আল্লাহ্ বা গডের কাছে পৌঁছাবে অথবা তার প্রার্থনাই বা কি করে সেখানে পৌঁছাবে ? একমাত্র অন্তরে প্রেমের স্রোত প্রবাহিত হোলে সেই স্রোতই পরমাত্মা-সাগরে (ঈশ্বর, আল্লাহ, গড) ঐ সাধক(স্রোতস্বিনী)-কে পৌঁছে দেবে।
এরপর গুরুমহারাজ বললেন – ” প্রেম – প্রেম – প্রেম ! একমাত্র প্রেম ! এই প্রেমের দ্বারা সব সমস্যার সমাধান হবে। প্রেমরূপ গঙ্গা – পরমাত্মারূপ সাগর, প্রেমে আরম্ভ – পরমাত্মায় অন্ত।” সুতরাং ধ্যান, জপ, পূজা, পাঠ, প্রার্থনা, নামাজ ইত্যাদি সবই বৃথা হয়ে যাবে__পরমেশ্বরের নামে যদি অন্তরে প্রেমভাব জাগ্রত না হয়। অন্তরে প্রেমের বর্ষা নামলে তবেই সেই জীবন স্রোতস্বিনী হয়ে উঠতে পারে – যা পরমেশ্বররূপ পরমাত্মা-সাগরে একদিন না একদিন মিলবেই। আর এটাই সকল ধর্মমতের উপাসনার প্রকৃত উদ্দেশ্য !
সেইজন্যেই গুরুমহারাজ বললেন – ” যারা একটি মানুষকে ভালোবাসতে পারলো না – তারা কেমন করে পরমাত্মাকে ভালোবাসবে ? মানবপ্রেম যাদের জাগলো না – তারা কি ভগবৎ প্রেমের যোগ্য ? মানবের স্বাস্থ্যই প্রেম, আর প্রেমহীনতাই অস্বাস্থ্য বা রোগ !”
তাহলে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, ভগবৎ প্রেম বা ঈশ্বরের প্রতি প্রেম জাগ্রত হবার আগে মানবের (সাধকের) মধ্যে মানবপ্রেম জাগ্রত হওয়া প্রথম প্রয়োজন। এটা তো চরম সত্যি কথা যে, ‘যার মধ্যে মানবের প্রতি ভালোবাসার বোধ নাই, তার দ্বারা পরমেশ্বরকে ভালোবাসা কি করে সম্ভব’ ?
এরপর গুরুমহারাজ প্রেম সম্বন্ধে আরও যা বললেন, তা হোলো – “প্রেম অকারণ, অর্থাৎ প্রেমের কোনো কারন নাই। তাই প্রেম স্বভাবজ। যখন মানব-হৃদয়ে প্রেমের বর্ষা নামে__ তখনই মানব-ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় এবং মানবের সম্পূর্ণতা আসে। প্রেমহীন মানব মৃতসম। এতে জীবনের লক্ষণ নাই। সেহেতু তারা অসহজ।” গুরুমহারাজ বললেন – “প্রেম অকারণ ! প্রেম স্বভাবজ।” — তার মানে মানবের প্রকৃতিতেই প্রেম রয়েছে – তবে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই ‘কাম’ ঐ ‘প্রেম’কে দাবিয়ে রাখে, মাথা তুলতেই দেয় না। এইজন্যেই সমস্ত ধর্মমতের শিক্ষাতেই নিয়ম-সংযম-ত্যাগ-বৈরাগ্য-উপাসনা বা সাধনা ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে মানবজীবনে ‘কাম’ প্রশমিত হয়ে ‘প্রেম’ জাগ্রত হয়ে ওঠে।
প্রেমই মানবের জীবনে শান্তি-সুখ-আনন্দ এনে দিতে পারে৷ আর শুধু একজন-দুজন মানবই নয়__ সমাজের অধিকাংশ মানুষ যেদিন এই সত্যের বোধ করবে সেদিন সমগ্র মানবসমাজে শান্তি নেমে আসবে, সমগ্র মানবসমাজে আনন্দ প্রতিষ্ঠিত হবে। সেইজন্যেই গুরুমহারাজ বলেছেন – “প্রেম – প্রেম – প্রেম ! একমাত্র প্রেম ! এই প্রেমের দ্বারাই সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে।”
যাইহোক, আমরা আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাই। এরপর গুরুমহারাজ বললেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – জীবনে প্রেমের বর্ষা নামলে ধ্যানের কিরণছটায় জ্ঞানের প্রকাশ হয়। প্রেম বা ধ্যান জীবন সাধনার এবং আত্ম-উপলব্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং ভালবাসতে থাকো! ভালোবাসাই পথ, প্রেম – সাধনা এবং পরমেশ্বর – লক্ষ্য ।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ – তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে, প্রেম – ধ্যান এবং জ্ঞান পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ! আত্ম-উপলব্ধির জন্য প্রেম এবং ধ্যান একান্ত প্রয়োজনীয়। আর একটা কথাও আমরা শিখলাম, সেটা হোচ্ছে – ‘প্রেম-ই হোলো সাধনা’ ! ভালবাসার পথ ধরে, প্রেমরূপ সাধনার দ্বারা, পরমেশ্বররূপ অন্তিম লক্ষ্যে সাধক পৌঁছে যেতে পারে।
গুরুমহারাজ তারপরে বলেছিলেন – ” ভালবাসতে–ভালবাসতে তোমার অন্তরে প্রেমের বর্ষা নেমে আসবে, আর (তখন) জ্ঞানের প্রকাশ ঘটবে। যারা অসহজ, তারা প্রেমিককে বলে উন্মাদ ! কিন্তু প্রেম সম্রাট ! ত্যাগের মহিমায় প্রেম উজ্জ্বল। নিঃস্বার্থ প্রেমই সহজ ধর্ম। প্রেমিকের মতো মহান সম্রাট আর কে আছে !’
একটা জিনিস আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন – গুরুমহারাজ বারবার জীবনে ‘প্রেমের বর্ষণ’ নেমে আসার কথা বলেছেন। শুধু প্রেম জাগ্রত হওয়াই নয় – জীবনে প্রেমের বর্ষা নামতে হবে। গুরুমহারাজ বলেছেন – “প্রেম সম্রাট !” কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, গুরু মহারাজ এটাও বলেছেন যে, ‘ত্যাগের মহিমায় প্রেম উজ্জ্বল’ ! আর ‘নিঃস্বার্থ প্রেমই মানবের সহজ ধর্ম’।৷