শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত এবং লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজের কথা থেকে আমরা আগের episode-এ জানতে পেরেছিলাম যে, মানবের মধ্যে পরমেশ্বরের ‘বোধ’ হোলে, সে অ-ভাব থেকে স্ব-ভাব এবং স্ব-ভাব থেকে মহাভাবে উন্নীত হয়। এটাকেই গুরুমহারাজ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন নামে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন – অসহজ মানব সহজ হয়, মানুষের মধ্যে ব্যষ্টি চেতনা থেকে সমষ্টি চেতনার উন্মেষ ঘটে, মানুষের জীবত্ব নাশ হয়ে_ সে শিবত্ব প্রাপ্ত হয়, ভক্ত অবস্থা থেকে সে ভগবান অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারে, মানুষের মধ্যেকার যে বাসনা এতোকাল ক্রিয়াশীল ছিল – যে বাসনার কারণে মানুষের জন্মজন্মান্তর সংঘটিত হয়েছে – সেই ‘বাসনা’ ‘প্রেমে’ রূপান্তরিত হয়ে যায়__ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাইহোক, গুরুমহারাজ এই ব্যাপারে আরো কি বলেছেন আমরা সেইটা শুনে নিই ! উনি এরপর বললেন – ” পরমজ্ঞানে ও পরমপ্রেমে স্বরূপতঃ কোনো ভেদ নাই। যতক্ষণ অপূর্ণতা, ততক্ষণই দ্বন্দ্ব। জীবন স্বরূপতঃ আত্মা বা ব্রহ্ম। মায়া বা অজ্ঞান সামান্য বুদ্ধির কারণ – এটাই অসহজতা ! মূলতঃ কোনো কিছুতেই ভেদ নাই, ভেদ শব্দটা মিথ্যা, যার প্রকৃত অস্তিত্ব নাই, ভ্রান্তি ও অসহজ অবস্থায় এর অস্তিত্ব অনুভব হয়, নতুবা কিছুই নয়৷” তার মানে_ আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, সাধারণভাবে আমাদের কাছে ‘জ্ঞান’ এবং ‘প্রেমে’র মধ্যে পার্থক্য থাকলেও absolute অবস্থায় অর্থাৎ পরমজ্ঞান ও পরমপ্রেমের অবস্থায় কোনো ভেদ থাকে না। সাধারণ জীব অপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলেই ভেদ প্রতীয়মান হোচ্ছে, জগৎ বা জীবন দ্বন্দ্বাত্মক বলে মনে হোচ্ছে – কিন্তু বাস্তবে তা নয় ! আমরা সাধারণ মানুষেরা ভ্রান্ত অবস্থায় – অজ্ঞান অবস্থায় – অপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি বলেই আমাদের মধ্যে ‘ভেদ’-এই ব্যাপারটা প্রতীত হোচ্ছে !
এরপর গুরুমহারাজ বললেন – ” যা দুই বা ভেদ – তাই ভ্রান্তি। মানবের অনুভূতিতে এই ভেদ কিসের জন্য ? – ‘আমি’-‘আমি’ ভাব, এইজন্য এতো ভেদ ! যতক্ষণ এই ‘আমি’-‘আমি’ ভাব থাকবে, ততক্ষণ ওই ভ্রান্তি বা ভেদও থাকবে – এটাই অহংকার বা অসহজতা। এই অহংকার যতক্ষন থাকবে, ততক্ষণ ভগবৎ প্রেমের অনুভব নাই।” শুনলেন তো গুরু মহারাজের কথা ! – ‘ যা দুই বা ভেদ – তাই ভ্রান্তি !’ –তার মানে হোচ্ছে ‘আমি’ যখনই আলাদা হোচ্ছে তখনই ‘আমি’ ছাড়া আর ‘কেউ’ বা ‘কিছু’ রয়েছে – আর এটাই ‘দুই’ ! আর এই আমি বা ‘এক’ এবং ‘দুই’ থেকেই বহু__ যা বিভিন্নতা বা বৈচিত্রতা সৃষ্টি করেছে। এটাকেই গুরুমহারাজ বলেছেন ‘ভেদ’ এবং এটাই ভ্রান্তি ! কারণ প্রকৃতপক্ষে ‘দুই’ বা বহু যা, তা সবই সেই ‘এক’ এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের (আল্লা, হরি, রাম, কালী, গড)-ই প্রকাশ ! ‘আমি’ বা ‘অহং’ এইটা বজায় থাকতে মানব কখনই সেই ‘এক’ পরমেশ্বরের ধারণাই আনতে পারবে না – বোধ তো দুর-অস্ত !
গুরুমহারাজ প্রেমের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে এরপর আরও বললেন – ” প্রকৃত প্রেম হোলো একাত্ম অনুভূতি ! সহজ প্রেমের অনুভূতি হোলো ‘আমি’-রূপ অহংকারের প্রাচীরটা লুপ্ত হয়ে যাওয়া অর্থাৎ যতক্ষণ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যেকার অহংকাররূপ প্রাচীরটা (যা স্বার্থরূপ কংক্রিটের প্লাস্টার করা) ভেঙে না পড়ে, ততক্ষণ প্রেমের অনুভূতি নাই। প্রেম অদ্বৈত ভূমির অনুভব – তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।” __দেখুন, উপরোক্ত কথাগুলি যে আমরা বুঝি না – তা তো নয় ! ‘আমি’ এই প্রাচীরটা আমার চারিদিকে দেওয়া রয়েছে বলেই তো ‘আমি-ই যে বহু’– এইটা দেখতে চাইছি না বা বুঝতে চাইছি না _ তাই নয় কি ? সাধু-সন্ত-মহাত্মা-মহাপুরুষরা প্রথমেই গৃহত্যাগ করেন (সংসারত্যাগ করা কথাটা ঠিক appropriate নয়, কারণ গুরুমহারাজ বলতেন, ‘ জগৎসংসার ত্যাগ করে তো আর কেউ যেতে পারে না, সুতরাং সন্ন্যাস হোলো ছোটো সংসার ত্যাগ করে বৃহৎ সংসারে প্রবেশ !’) ! এতে কি হয় – ‘আমি-আমার’ এই যে অহংভাব – এটা প্রথম থেকেই ক্ষয়প্রাপ্ত হোতে শুরু করে। এরপর দন্ড-কৌপিন সম্বল হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো বা লোকালয় থেকে দূরে কোনো গিরি-গুহা অথবা অরণ্যে একাকী সাধন-ভজন করা (লোকালয়ে থাকলে কোনো মঠ-মিশনের সাথে যুক্ত হয়ে জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা), এতে কুলগর্ব, যৌবনগর্ব, ধনগর্ব, বিদ্যার গর্ব ইত্যাদি অহং-অস্মিতার অবসান ঘটতে থাকে এবং সাধক ধীরে ধীরে ‘আমি’-রূপ প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়।
সেই সাধক তখন ব্যষ্টি-আমি থেকে সমষ্টি-আমি ভাবে উপনীত হয়। এরফলে ঐ অবস্থার মানব (সাধক) যেখানেই থাকুক না কেন – তার দ্বারা মানবের তথা সমাজের শুধুমাত্র মঙ্গল-কারক কাজই হবে, কোনো negative চিন্তা ঐ সাধকের মনোজগতে ক্রিয়া না করায়__ তাঁর চতুর্দিকে শুধুমাত্র positive field-এর বাতাবরণ‌ই তৈরি হবে।
এইভাবেই মহাত্মা-মহাপুরুষগণ সমাজের প্রকৃত ভালো বা প্রকৃত মঙ্গলসাধন করে থাকেন – যেগুলি সাধারন মানুষেরা বিশেষ জানতেও পারে না। যাই হোক, সমষ্টিচেতনায় পৌঁছে বা প্রকৃত প্রেমের রাজ্যে পৌঁছাতে পারলে, তবেই সকলকে সম্বোধন করা যায় – ‘প্রিয় আত্মন্‌’ ! অর্থাৎ তখন ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু’ অবস্থা প্রাপ্ত হ‌ওয়া যায়! এই অবস্থা থেকেই ঋষিরা জগতের সকল মানুষকে সম্বোধন করে বলতে পেরেছিলেন – ” অমৃতস্য পুত্রাঃ” !
এরপর গুরুমহারাজ প্রকৃত প্রেমের ব্যাখ্যায় আর কি বলেছেন, তা আমরা দেখে নিই ! উনি বলেছেন – ” ভালোবাসা মানে শুধু হা-হুতাশ নয়, কিংবা কেবল সুখের কথা বা চোখের জল ফেলা নয় অথবা কেবল মনের বৃত্তি বা মানসিক উত্তেজনাও নয়। ভালোবাসার তাড়ণায় মানব অপরের কষ্ট মোচনের জন্য নিজেকে ভুলে যায়। ভালবাসার তাড়ণা – (মানবের) আচরণে প্রকটিত হয়। ভালোবাসার তাড়ণাতেই ঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন মহামানবগণ। আদর্শ প্রেমিক চরিত্রের উৎকর্ষ, মানবকে যেরূপ মহিমান্বিত করে থাকে – দেবতারাও তার কাছে নত হ’ন। সমগ্র প্রাণীজগতের প্রতি অতলান্ত ভালোবাসাই হোলো মহাপ্রেমিকের লক্ষণ। প্রেম হোলো অন্ধকার হোতে জ্যোতিতে উত্তরণের আকুতি। প্রেমের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বস্তুতঃ মানব একটি ভাবসত্তা – আর এই জড়দেহকে আশ্রয় করে ঐ ভাবসত্তারই অভিবিকাশ বা প্রকাশ !”