শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্তরচিত গ্রন্থ *সহজতা ও প্রেম* থেকে ‘প্রেম’ বিষয়ক কথায় ছিলাম। আগের দিনের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম, গুরুমহারাজ বলেছেন – ” আনন্দময় পরমেশ্বরকে ভুলেই মানবের যত প্রকার দুর্গতি !” প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এখানে একটা কথা কিন্তু চিন্তা করার রয়েছে ! আর সেটা হোলো – পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষই তো কোনো না কোনো ধর্মমতের সঙ্গে যুক্ত – তা সে বহুল প্রচলিত হোক বা অপ্রচলিত বা লোকায়ত-ই হোক, মানুষ তো যে কোনো ভাবে – যে কোনো নামে সেই পরমেশ্বরকেই ভজনা করে থাকে ! তাঁরই স্তব-স্তুতি-পূজা-পাঠ-যজ্ঞ-আরতি করে থাকে ! তাহলে মানবের দুর্গতির জন্য পরমেশ্বরকে ভুলে যাবার কথা গুরুমহারাজ বললেন কেন ?
গুরুমহারাজ কি আর ভুল বলতে পারেন ? উনি সবসময়েই ঠিক কথা বলবেন। বহুকাল আগে থেকেই উনি(ঈশ্বরের অবতারগণ) ঠিকঠাক কথা মানবসমাজের উদ্দেশ্যে বলে চলেছেন – কিন্তু তাতে কি ? পৃথিবী গ্রহের সর্বোন্নোত প্রাণী, চেতনায় শিশু অবস্থায় থাকা মানুষ বারবার ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করেছে ! ঈশ্বরের অবতারগণকে অথবা তাঁর প্রেরিত দূতদের অর্থাৎ বিভিন্ন মহাত্মা-মহাপুরুষদের কথা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছে, তাঁদের শিক্ষাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতো করে নিয়েছে, মূলভাবকে বিকৃত করেছে – এই তো মানব সমাজের অগ্রগতির ইতিহাস ! মোদ্দা কথা হোলো – “পরমেশ্বরকে ভুলেই মানবের যত দুর্গতি”!
‘পরমেশ্বর প্রেমস্বরূপ এবং আনন্দময়’ ৷ তাহলে পরমেশ্বরকে যে ঠিক ঠিক ধরে থাকবে তার জীবনও প্রেমময় হয়ে উঠবে, আনন্দময় হয়ে উঠবে ! কিন্তু তা আর আমরা কোথায় দেখতে পাচ্ছি ? বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষেরাই তো তাদের নিজ নিজ মত অনুযায়ী আড়ম্বর সহকারে – ঘটা করে পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে তাদের পূজা-প্রার্থনা-স্তব-স্তুতি নিবেদন করে চলেছে, অথচ তাদের জীবনে তো প্রেম প্রকটিত হোচ্ছে না – জীবন আনন্দময় হয়ে উঠছে না ! তার মানে নিশ্চয়ই ”বিসমিল্লায় গলদ” রয়ে গেছে ! এই গলদ না মারতে পারলে অর্থাৎ পরমেশ্বরের উপাসনার দ্বারা মানব হৃদয়ে প্রেমবোধ জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত ধর্মের আচরণ করাই সার – কাজের কাজ কিছুই হোলো না !
যাইহোক, এরপর গুরুমহারাজ কি বলেছেন আমরা সেইদিকে দৃষ্টি দিই ! এরপরে গুরুমহারাজ আমাদের মতো সাধারন মানুষের করা একটা জিজ্ঞাসা নিজে নিজেই তুলে তার উত্তর দিয়েছেন। উনি বলেছেন – ” সংসারে কেউ কেউ বলে থাকেন – সবই যদি তাঁর ইচ্ছায় হয়, তাহলে আমার এই দোষ-ত্রুটিগুলি তিনি ঠিক করে দেন না কেন ? যা কিছু সবই তো ‘তিনি’ করেন, তাহলে এটাই (বা) করেন না কেন ? – এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, ‘কর্তৃত্ববোধ’ যার আছে, আত্মবোধের চেষ্টার প্রয়োজনও কিন্তু তার আছে। আপন কর্তৃত্বের অভিমান নিয়ে মানব বলছে – ‘ তিনি তো সবই করেন, তাঁর ইচ্ছায় যদি সবই হয়, তাহলে আমারটা হোচ্ছে না কেন?’ – এই কর্তৃত্ববোধের অভিমান যতক্ষণ না তার যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে আত্মপ্রয়াস বা প্রচেষ্টাও করে যেতে হবে।’ আত্মাভিমান বিদূরিত হোলে সম্পূর্ণ নির্ভরতা আসে, আর তখনই মানবের সম্পূর্ণরূপে নির্বাক নিশ্চেষ্টভাবে থাকা সম্ভব। সুতরাং মানবের আত্মাভিমান বা কর্তৃত্ববোধ থাকতে, তাকে তার দোষ-ত্রুটি এবং প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে।”
সত্যিই তো আমাদের মধ্যে যথেষ্ট আত্মাভিমান, কর্তৃত্ববোধ, অহংবোধ রয়েছে – আর আত্মবোধের ছিটেফোঁটাও নাই, কারণ আত্মবোধের প্রচেষ্টাও নাই ! গুরুমহারাজ এই চরম সত্যের সন্ধানই আমাদেরকে দিলেন। উনি যা বললেন, তার মর্মার্থ হোলো এই যে, আত্মবোধ না জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত মানবের আত্ম-অভিমান যাবার নয়, আর আত্মাভিমান বা কর্তৃত্ববোধ থাকাকালীন সময় পর্যন্ত তাকেই আত্মবোধের জন্য আত্মপ্রয়াস বা প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। ‘পরমেশ্বর করে দিচ্ছে না কেন’– এই অজুহাত কার্যকরী হবে না। ভোগ-বাসনা-কামনা এইগুলি তোমার, মান-যশ-ঐশ্বর্য তোমার, ঐগুলি লাভের প্রচেষ্টা তোমার, আর আত্মবোধের প্রচেষ্টা বা তোমার জীবনের দোষ-ত্রুটি মুক্ত হবার জন্য প্রচেষ্টাটি ঈশ্বর করে দেবেন ?? এতো বড় প্রবঞ্চনা আর হয় না কি ? তবে এটাও ঠিক যে, এই ধরনের প্রবঞ্চনা হয়ে চলেছে_ আর তাই তো আজকের মানবের এই দুর্গতি !
এসব কথা থাক্, আমরা আবার ফিরে যাই গুরুমহারাজের কথায়। এরপর উনি বললেন – ” অভিমানশূন্য মানবই একমাত্র সম্পূর্ণ ঈশ্বরে নির্ভরতা রাখেন এবং নিশ্চেষ্টভাবে থাকতে পারেন ৷ তাই মানবের ক্ষুদ্র আমিত্বকে বা অহংকারকে দূর করার জন্য সচেষ্ট হয়ে সংগ্রাম করতে হবে। সচেষ্ট সংগ্রামের দ্বারা কর্তৃত্বের অভিমান বিলুপ্ত হোলে মানব আপনা আপনিই নিশ্চেষ্ট হবে, তার ঈশ্বরে নির্ভরতা আসবে ও (সে) পরম প্রেমিকে পরিণত হবে।” আহা ! এমন দিন পরমানন্দ ভক্তদের সবার জীবনে যদি এই জন্মে নেমে আসতো – তাহলে কি ভালোই না হোতো ! তবে চিন্তার কোনো কারন নাই, উনি যাদের ভার নিয়েছেন – তাদের আর (খুব বেশী হোলেও) তিনটি জন্ম !! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” জাত সাপে ধরলে তিন ডাক ।”
কিন্তু সেসব যাই হোক, সাধন-ভজন কিন্তু করতেই হবে। যার যেটুকু সময়, যতটা সুযোগ – তাকে ততোটাই সাধন-ভজন করতে হবে। ‘ভক্ত এক পা আগালে ভগবান একশো পা এগিয়ে আসবেন’– এটি গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দেরই অমোঘ বাণী। তাই ঐ এক পা’ এগিয়ে যাবার জন্যেই সাধন-ভজনটা প্রয়োজন ।৷