শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের নিজের লেখা প্রথম গ্রন্থ “সহজতা ও প্রেম” থেকে ‘প্রেম’ বিষয়ক আলোচনাগুলি এখানে তুলে ধরেছিলাম এবং স্বয়ং ভগবানের কথার রস-আস্বাদন করছিলাম। গুরুমহারাজ একবার বলেছিলেন, এই বইটির পাণ্ডুলিপি লেখার সূচনা হয়েছিল হিমালয় ভ্রমণকালীন সময়ে। পরবর্তীতে আমি ন’কাকার (শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) মুখে শুনেছিলাম যে, গুরুমহারাজ যখন প্রথম বনগ্রামে পদার্পণ করেছিলেন (১৯৭৮ সালে), তখন উনি ন’কাকাদের মাটির দোতলার উপরের ডানদিকের ঘরটিতে থাকতেন এবং ওখানেই ওনার বইগুলির (সহজতা ও প্রেম, বাউলের মর্মকথা – ইত্যাদি) পান্ডুলিপি সম্পূর্ণ করেছিলেন বা fresh copy তৈরি করেছিলেন।
আপনারা (হয়তো অনেকেই জানেন) শুনলে আরো একটু অবাক হবেন যে, গুরুমহারাজের প্রথমদিকের manuscript সম্ভবতঃ সাধুভাষায় লেখা হয়েছিল। যদিও সেই manuscript আমার দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি – কিন্তু একেবারে গোড়ার দিকে, যখন আশ্রমের পরিসর ছোটো ছিল – লোকজনের আগমন খুবই কম ছিল – তখন আশ্রমিকদের সবার অনেকটাই সময় ছিল, আর এই সময়ের উপযোগ হিসাবে [সম্ভবতঃ তপিমার (পবিত্রপ্রাণা) ব্যবস্থাপনায়) গুরুমহারাজের রচনার পান্ডুলিপি পাঠ, ওনার লেখা কবিতার পাঠ, কিছু কিছু গান – ইত্যাদির recording করা হয়েছিল। সেইসব cassete আমরা শুনেছিলাম (এখনও অনেকের কাছে রয়েছে), তাতে দেখেছিলাম গুরুমহারাজ বর্তমানের “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থের বিষয়গুলি সাধুভাষায় পাঠ করছেন ! আরো আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাণ্ডুলিপি থেকে যখন “সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থটির লেখাগুলি চলতি ভাষায় রূপান্তরিত করে ছাপা আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল – তখন গুরুমহারাজের original লেখার অনেক কথাই বাদ পড়েছে, দু-তিনটি ছোটো ছোটো বাক্যকে একটা বাক্যে পরিণত করতে গিয়ে গুরুমহারাজের অনেক কথারই মাধুর্য‌ও কমেছে !
কিন্তু এটাও ঠিক যে, গুরুমহারাজ শরীরে থাকাকালীন সময়েই “সহজতা ও প্রেম”- বইটি ছাপার আকারে বের হয়েছিল। গুরুমহারাজ সব ব্যাপারটা খুশী মনে মেনেও নিয়েছিলেন। তাহলে আপনারা কি বলবেন বলুন ! তবে এইসব ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখে আমার যা মনে হয়েছে তা হোলো এই যে, যুগে যুগে যুগপুরুষদের সব কথা সমাজের মানুষ কখনোই জানতে পারে না। আগেও কখনো জানতে পারে নি, এখনও পারলো না, আর পরেও পারবে না !
“শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” বা সমসাময়িক অন্যান্য গ্রন্থ সম্বন্ধেও আমরা গুরু মহারাজের কাছে শুনেছিলাম যে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তৎকালীন কামারপুকুরের একেবারে গেঁয়ো-ভাষায় কথা বলতেন। এদিকে মাষ্টারমশাই মহেন্দ্র বাবু ছিলেন খাস কলকাতার মানুষ। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, রুচিশীল, আধুনিক মনস্ক ব্যক্তি। তাঁর প্রত্যহ ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল_ফলে, তিনি যখন ঠাকুরের বলা কথাগুলো ডায়েরীতে লিখতে শুরু করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর নিজের অভ্যাসমতো ভাষাতেই করেছিলেন। পরবর্তীতে একটু-আধটু পরিবর্তন করা গেলেও সম্পূর্ণ তো আর করা যায় নি ! সুতরাং ঐ গ্রন্থগুলিতেও আমরা ঠাকুরের বলা কথাগুলি যথাযথ পাই নি !
আপাতদৃষ্টিতে এইসব ব্যাপারগুলো চরম অনিয়ম মনে হোলেও – এটাই যেন এই জগতের অমোঘ নিয়ম। ভগবানও (ঈশ্বরের অবতারগণ) এটাকে মেনে নেন, কারণ, তিনি জানেন যে, পৃথিবী গ্রহের মানুষ এখনো এতোটা উন্নত হয়নি যে ‘ভগবান’-কে ঠিকঠিক নিতে পারবে ! তিনি এতেই সন্তুষ্ট হ’ন যে, ” যাইহোক মানুষ খানিকটা তো নিতে পেরেছে !i পরম প্রেমময় করুণাময় ভগবান পৃথিবীর মানুষদের কাজকর্মকে করুণার দৃষ্টিতেই দেখেন, প্রেম দিয়েই বিচার করেন !
যাইহোক, আমরা গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে এবার মূল বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করি। আমরা আগেরদিন গুরুমহারাজের লেখা যে কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম – এখন তারপর থেকে উল্লেখ করার চেষ্টা করি। গুরুমহারাজ এরপরে বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – পরমেশ্বর সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পূর্ণ করে আছেন এবং তাঁর বাইরে আর কোনো স্থান নাই। সমস্ত স্থানেই তাঁর ভিতরে। সব রূপ তাঁর মধ্যেই অবস্থিত। আর সমস্ত নাম তাঁরই, কোনো নাম তাঁর নিকট অপরিচিত নয়।” আগের দিনের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম যে, গুরুমহারাজ মানবসকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন – “তোমরা অভিমান শূন্য হও।” এছাড়াও উনি মানবের ক্ষুদ্র আমিত্ব ও অহংকারকে দূর করার জন্য সচেষ্ট হোতে বলেছিলেন। এমনটা হোতে পারলে কি হবে – তাও উনি বলে দিয়েছিলেন। আর তা হোলো – অভিমান, আমিত্ব, অহংকার দূর করতে পারলে – মানুষের ঈশ্বরে নির্ভরতা আসবে, মানব ধীরে ধীরে পরম প্রেমিকে পরিণত হবে।
আর আজকের উল্লেখিত গুরুমহারাজের কথা থেকে আমরা “পরমেশ্বর” সম্বন্ধে সঠিক ব্যাখা পেলাম। আমরা এটাই জানলাম যে, ‘পরমেশ্বরের বাইরে’- বলে কোনো কথা হয় না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুই তাঁর ভিতরে। পরিদৃশ্যমান জগতের এই যে হাজার হাজার নাম ও রূপের ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে – সেগুলো সবই পরমেশ্বরের ভিতরে অবস্থিত। সবকিছুই – তা সে যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বা বৃহতাতিবৃহৎ হোক না কেন – পরমেশ্বরের অপরিচিত নয়।
তাহলে পাঠকবৃন্দ ! বোঝা যাচ্ছে তো ‘পরমেশ্বর’ বলতে ঠিক কী বোঝায় ? এই পরমেশ্বরকেই মুসলমানেরা বলে “আল্লাহ”, খ্রীস্টানরা বলে “গড”, কেউ বলে “জিহোবা”, কেউ বলে “মারাংবুরু”– হিন্দুগণ ঈশ্বর, পরমেশ্বর, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-কালী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে সেই পরমেশ্বরকেই আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু এইসব কিছু করেও আসল ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো ?
ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে, জগতে যত রকমের ভেদ-দৃষ্টি রয়েছে, সংকীর্ণতা রয়েছে, স্বার্থবুদ্ধি রয়েছে – ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ (তা সে যে কোনো ধর্মমতের-ই হোক না কেন) ঈশ্বর বা পরমেশ্বর (আল্লা, হরি, রাম, গড ইত্যাদি) সম্বন্ধে নূন্যতম ধারণাও করতে পারবে না। বৃথাই মানবের ধ্যান-ধারণা, পূজা-প্রার্থনা, মন্দির-মসজিদ-গির্জায় গিয়ে মাথা ঠোকা – সব বৃথা ! একেবারে বৃথা_তা বলা যায় না, এটা শুধুমাত্র জীবনের কর্মের অভিজ্ঞতাপুষ্ট হয়ে সামান্য একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। পূর্ণত্বের পথে ‘চরৈবেতি’-র চিকন রেখাটি ধরে ‘এগিয়ে চলা’ নয়।