শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দে কথা (কথিত এবং লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজ তাঁর স্বহস্তরচিত প্রথম গ্রন্থ *সহজতা ও প্রেম*-এ প্রেম বিষয়ক যে সব আলোচনা করেছিলেন আমরা সেইসব আলোচনায় ছিলাম। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – প্রত্যেকটা মানবের মধ্যে সহজাতক্রমে একটা প্রেরণা বা ভালোবাসা বিদ্যমান। এইজন্য মানব ভাবপ্রবণ বা স্নেহপ্রবণ। এটাই হোলো মানবজীবনের বৈশিষ্ট্য। ঐ প্রেরণা বা ভালোবাসা যখন কোনো প্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তীব্র থেকে তীব্রতর হোতে থাকে, তখন মানবের অন্তর্জগতে এক স্নিগ্ধ মাধুর্যময় নৈসর্গিক অবস্থার উন্মেষ হয়। এই অবস্থাকে ‘ভাব’ বলা হয়। তারপর ঐ ভাব যখন ক্রমশ গভীর হোতে গভীরতর অবস্থার ভিতর দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ গাঢ় অবস্থা প্রাপ্ত হয় – তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় *প্রেম*৷”
এখানে গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী আমরা তিনটি স্তর বা ধাপের কথা জানতে পারলাম। সেগুলি হোলো যথাক্রমে – (১) সহজাত প্রেরণা বা ভালোবাসা, (২) ভাব এবং (৩) প্রেম।৷ তার মানে হোচ্ছে – আমরা সাধারন মানুষেরা যে ভালোবাসা এবং ‘প্রেম’কে একই মনে করি – তা কিন্তু ঠিক নয়। সাধারণ ভালোবাসা হোলো মানবের মধ্যেকার সহজাত প্রেরণা – যার জন্য মানব ভাবপ্রবণ হয় এবং স্নেহপ্রবণ হয় এবং এটা হোলো মানব জীবনের বৈশিষ্ট্য। এই ভাবপ্রবণতা বা স্নেহপ্রবণতা ব্যাপারটা মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে থাকে না। সে যাই হোক, গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী মানবের অন্তর্জগতের সহজাত প্রেরণা বা ভালোবাসা যখন কোনো প্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় – তখন সেখানে (অন্তর্জগতে) এক বিশেষ নৈসর্গিক অবস্থার উন্মেষ হয় – যা স্নিগ্ধ এবং মাধুর্যময় – সেই অবস্থাই *ভাব*!
প্রিয় পাঠক ! আমরা ‘ভাব’ – ‘ভাবনা’ এই কথাগুলিকে কি সহজেই উচ্চারণ করে থাকি, কথায় কথায় মানুষকে ‘ভাববাদী’ বলে ‘হ্যাঁটা’ সেটা করি ! কিন্তু মানবের অন্তর্জগতের এই ‘ভাব’ কত গভীর অবস্থা – তা আমাদের অবশ্যই ধারণা হোচ্ছে। ‘ভাব’ অবস্থা গভীর থেকে গভীরতর হোলে এবং তা যখন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে বা গাঢ় অবস্থা প্রাপ্ত হয় – তখন তাকে বলা হয় *প্রেম*! সুতরাং ‘ভালবাসা’ এবং ‘প্রেম’ মোটেই একই অর্থ প্রকাশ করে না !
যাইহোক, আমরা আবার দেখি, এরপর গুরুমহারাজ কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” সেই প্রেমাবিষ্ট মানব (যার মধ্যে প্রেম প্রকটিত হয়েছে) তখন অনুভব করে থাকে এক অনাবিল উল্লাস ! তা-ই মানবের চিরআকাঙ্খিত ভূমানন্দ বা পরম আনন্দতত্ত্ব। সেই তত্ত্ব সমস্ত কালের সীমাকে অতিক্রম করে ব্যপ্ত রয়েছে – সেইজন্য তা অনন্ত। সমস্ত দেশ, কাল ও পাত্র তাতে আবিষ্ট এবং তা দেশ, কাল ও পাত্রের উর্দ্ধে, তাই তা অসীম ও অপরিমেয়।”
“প্রেমাবিষ্ট মানব অনুভব করে এক অনাবিল উল্লাস।”– গুরুমহারাজের এই কথাগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, যাঁর মধ্যে প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে – তিনিই উল্লাসময়, তিনি সদানন্দময় – নিত্যানন্দময় ! সদাসর্বদা তিনি আনন্দে বিরাজিত আছেন, সদাই অপার্থিব শান্তির মাঝেই থাকেন। ফলে, তাঁর নিকটস্থ হোতে পারলেই সাময়িক হোলেও ‘আনন্দ’ ও ‘শান্তি’র সন্ধান পায়। আর ঐ অপার্থিব আনন্দ ও শান্তির অমোঘ আকর্ষণেই মানুষ ছুটে ছুটে যেতে চায় তাঁর কাছে ! এটাই আকর্ষণী মুদ্রা ! এটাই কৃষ্ণের বাঁশি – ব্যাপারটা আর কিছুই নয় ! বাঁশি বাজলে – যেমন গোপিনীদের সেই টানে না গিয়ে উপায় থাকে না – এখানেও ব্যাপারটা সেইরকমই হয়। বৃন্দাবনের হাজার হাজার মানুষেরা, সব গোপ-গোপীনীরাই তো শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে যমুনার উজান পথে ছুটে যেতো না অথবা বৃন্দাবনের সবাই তো রাসমঞ্চে প্রবেশাধিকার পায়নি ! ঐ ৮+৮=১৬ জন – তার বেশি আর নাম পাওয়া যায় না ! ঠিক তেমনি ভগবানের কাছে, মহাত্মা-মহাপুরুষদের কাছে অনেক মানুষই আসে – তারা তাঁর অপার্থিব প্রেমের স্পর্শও পায়, কিন্তু আত্মকৃপা না থাকায় অর্থাৎ সাধন-ভজন না থাকায় – চরম বা পরম লক্ষ্যে পৌঁছানো হয়ে ওঠে না !
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন – ” যাকে পেলে সবই পাওয়া হয় অর্থাৎ সর্বস্ব প্রাপ্তির বোধ হয়, সেই বোধের নিকট সমস্ত চলমান বিষয়বোধ ম্লান। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের নিবিড় জমাট যে অপার্থিব সম্পর্ক – কোনো কথা তাঁকে ব্যক্ত করতে পারে না। কারণ তত্ত্বকথা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই অবস্থা শাস্ত্রকথা বা তর্ক প্রতিপাদ্য বিষয় নয় এবং তর্ক বা শাস্ত্রবচন দ্বারা এর অনুভব হয় না। জীবনের মধ্য দিয়ে ও সহজ বাস্তব বোধের মাধ্যমেই এর যথার্থ অনুভব সম্ভব। সহজ ও সাবলীলভাবে আপনার মধ্যে আপনার দ্বারাই এর বোধ হয়, অপরের সাহায্যের প্রয়োজন নাই।”
সাধকের জীবনে ‘প্রেম’-লাভকেই গুরুমহারাজ ‘পরম পুরুষার্থ’ বা পরম পাওয়া বলে অভিহিত করেছেন। যা লাভ করলে আর কিছু লাভের আকাঙ্খা থাকে না – সর্বোচ্চ প্রাপ্তির বোধ হয়। পূর্ণত্ব লাভ হওয়াই প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মধ্যে নিবিড় জমাট সম্পর্ক স্থাপন। এই যে মিলনাবস্থা, অপার্থিব আনন্দ বা শান্তি অবস্থা – এটাকেই কোনো কথা দিয়ে ব্যক্ত করা যায় না, কোনো শাস্ত্রবচন বা তর্ক-আলোচনা দ্বারা ঐ অবস্থার অনুভব করা যায় না। কারণ, শাস্ত্রকথা আর সাধকের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা ! আর এই কথাটা জীবনের সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – সেটা আমরাও জানি। তবে প্রকৃত প্রেমের বোধ জীবনে সাধনার মধ্য দিয়ে এবং সহজ বাস্তববোধের মাধ্যমেই যথার্থ অনুভব হয়, নিজের মধ্যে এবং নিজের সাধনার দ্বারা সহজ ও সাবলীলভাবেই প্রেমের বোধ হয় – এর জন্য অন্য কোনো কিছুর বা অন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।৷
এখানে গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী আমরা তিনটি স্তর বা ধাপের কথা জানতে পারলাম। সেগুলি হোলো যথাক্রমে – (১) সহজাত প্রেরণা বা ভালোবাসা, (২) ভাব এবং (৩) প্রেম।৷ তার মানে হোচ্ছে – আমরা সাধারন মানুষেরা যে ভালোবাসা এবং ‘প্রেম’কে একই মনে করি – তা কিন্তু ঠিক নয়। সাধারণ ভালোবাসা হোলো মানবের মধ্যেকার সহজাত প্রেরণা – যার জন্য মানব ভাবপ্রবণ হয় এবং স্নেহপ্রবণ হয় এবং এটা হোলো মানব জীবনের বৈশিষ্ট্য। এই ভাবপ্রবণতা বা স্নেহপ্রবণতা ব্যাপারটা মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে থাকে না। সে যাই হোক, গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী মানবের অন্তর্জগতের সহজাত প্রেরণা বা ভালোবাসা যখন কোনো প্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় – তখন সেখানে (অন্তর্জগতে) এক বিশেষ নৈসর্গিক অবস্থার উন্মেষ হয় – যা স্নিগ্ধ এবং মাধুর্যময় – সেই অবস্থাই *ভাব*!
প্রিয় পাঠক ! আমরা ‘ভাব’ – ‘ভাবনা’ এই কথাগুলিকে কি সহজেই উচ্চারণ করে থাকি, কথায় কথায় মানুষকে ‘ভাববাদী’ বলে ‘হ্যাঁটা’ সেটা করি ! কিন্তু মানবের অন্তর্জগতের এই ‘ভাব’ কত গভীর অবস্থা – তা আমাদের অবশ্যই ধারণা হোচ্ছে। ‘ভাব’ অবস্থা গভীর থেকে গভীরতর হোলে এবং তা যখন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে বা গাঢ় অবস্থা প্রাপ্ত হয় – তখন তাকে বলা হয় *প্রেম*! সুতরাং ‘ভালবাসা’ এবং ‘প্রেম’ মোটেই একই অর্থ প্রকাশ করে না !
যাইহোক, আমরা আবার দেখি, এরপর গুরুমহারাজ কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” সেই প্রেমাবিষ্ট মানব (যার মধ্যে প্রেম প্রকটিত হয়েছে) তখন অনুভব করে থাকে এক অনাবিল উল্লাস ! তা-ই মানবের চিরআকাঙ্খিত ভূমানন্দ বা পরম আনন্দতত্ত্ব। সেই তত্ত্ব সমস্ত কালের সীমাকে অতিক্রম করে ব্যপ্ত রয়েছে – সেইজন্য তা অনন্ত। সমস্ত দেশ, কাল ও পাত্র তাতে আবিষ্ট এবং তা দেশ, কাল ও পাত্রের উর্দ্ধে, তাই তা অসীম ও অপরিমেয়।”
“প্রেমাবিষ্ট মানব অনুভব করে এক অনাবিল উল্লাস।”– গুরুমহারাজের এই কথাগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, যাঁর মধ্যে প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে – তিনিই উল্লাসময়, তিনি সদানন্দময় – নিত্যানন্দময় ! সদাসর্বদা তিনি আনন্দে বিরাজিত আছেন, সদাই অপার্থিব শান্তির মাঝেই থাকেন। ফলে, তাঁর নিকটস্থ হোতে পারলেই সাময়িক হোলেও ‘আনন্দ’ ও ‘শান্তি’র সন্ধান পায়। আর ঐ অপার্থিব আনন্দ ও শান্তির অমোঘ আকর্ষণেই মানুষ ছুটে ছুটে যেতে চায় তাঁর কাছে ! এটাই আকর্ষণী মুদ্রা ! এটাই কৃষ্ণের বাঁশি – ব্যাপারটা আর কিছুই নয় ! বাঁশি বাজলে – যেমন গোপিনীদের সেই টানে না গিয়ে উপায় থাকে না – এখানেও ব্যাপারটা সেইরকমই হয়। বৃন্দাবনের হাজার হাজার মানুষেরা, সব গোপ-গোপীনীরাই তো শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে যমুনার উজান পথে ছুটে যেতো না অথবা বৃন্দাবনের সবাই তো রাসমঞ্চে প্রবেশাধিকার পায়নি ! ঐ ৮+৮=১৬ জন – তার বেশি আর নাম পাওয়া যায় না ! ঠিক তেমনি ভগবানের কাছে, মহাত্মা-মহাপুরুষদের কাছে অনেক মানুষই আসে – তারা তাঁর অপার্থিব প্রেমের স্পর্শও পায়, কিন্তু আত্মকৃপা না থাকায় অর্থাৎ সাধন-ভজন না থাকায় – চরম বা পরম লক্ষ্যে পৌঁছানো হয়ে ওঠে না !
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন – ” যাকে পেলে সবই পাওয়া হয় অর্থাৎ সর্বস্ব প্রাপ্তির বোধ হয়, সেই বোধের নিকট সমস্ত চলমান বিষয়বোধ ম্লান। প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের নিবিড় জমাট যে অপার্থিব সম্পর্ক – কোনো কথা তাঁকে ব্যক্ত করতে পারে না। কারণ তত্ত্বকথা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই অবস্থা শাস্ত্রকথা বা তর্ক প্রতিপাদ্য বিষয় নয় এবং তর্ক বা শাস্ত্রবচন দ্বারা এর অনুভব হয় না। জীবনের মধ্য দিয়ে ও সহজ বাস্তব বোধের মাধ্যমেই এর যথার্থ অনুভব সম্ভব। সহজ ও সাবলীলভাবে আপনার মধ্যে আপনার দ্বারাই এর বোধ হয়, অপরের সাহায্যের প্রয়োজন নাই।”
সাধকের জীবনে ‘প্রেম’-লাভকেই গুরুমহারাজ ‘পরম পুরুষার্থ’ বা পরম পাওয়া বলে অভিহিত করেছেন। যা লাভ করলে আর কিছু লাভের আকাঙ্খা থাকে না – সর্বোচ্চ প্রাপ্তির বোধ হয়। পূর্ণত্ব লাভ হওয়াই প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মধ্যে নিবিড় জমাট সম্পর্ক স্থাপন। এই যে মিলনাবস্থা, অপার্থিব আনন্দ বা শান্তি অবস্থা – এটাকেই কোনো কথা দিয়ে ব্যক্ত করা যায় না, কোনো শাস্ত্রবচন বা তর্ক-আলোচনা দ্বারা ঐ অবস্থার অনুভব করা যায় না। কারণ, শাস্ত্রকথা আর সাধকের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা ! আর এই কথাটা জীবনের সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – সেটা আমরাও জানি। তবে প্রকৃত প্রেমের বোধ জীবনে সাধনার মধ্য দিয়ে এবং সহজ বাস্তববোধের মাধ্যমেই যথার্থ অনুভব হয়, নিজের মধ্যে এবং নিজের সাধনার দ্বারা সহজ ও সাবলীলভাবেই প্রেমের বোধ হয় – এর জন্য অন্য কোনো কিছুর বা অন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।৷