শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত এবং লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত-লিখিত প্রথম গ্রন্থ সহজতা ও প্রেম -এর একেবারে শেষভাগে। আমরা আগের আগের সংখ্যায় দেখেছিলাম যে, সকল মানুষের প্রতি গুরুমহারাজের প্রেম যেন উথলে উথলে উঠছে। উনি প্রাণপণে এবং আন্তরিকভাবে চেয়েছেন – আমাদের মতো সকল মানুষ ‘সহজ’ হয়ে উঠুক এবং আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই যেন প্রকৃত প্রেমলাভ হয়৷ কারণ প্রেমলাভ-ই হোলো পরম পুরুষার্থ এবং প্রতিটি মানবজীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ! এই প্রেম সাধারণ নর-নারীর শারীরিক আকর্ষণজনিত যে প্রেম-ভালোবাসা – সেটি নয়, এই প্রেম সার্বজনীন, এর বিস্তার শুধুমাত্র পরিবার বা সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে – তা নয়। সাধকের জীবনে পরম পুরুষার্থরূপ প্রেম জাগ্রত হোলে__ এটি দেশ-কাল-পাত্রের সীমা ছাড়িয়ে অনন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়।
এই প্রেমে নর-নারী, ভালো-মন্দ, নিন্দা-স্তুতি, আপন-পর ইত্যাদির ভেদ থাকে না ! সম্প্রদায়চেতনা, শ্রেনীচেতনা, গোষ্ঠীচেতনা – এইগুলি ক্রিয়াশীল থাকে না ! তখন জীবমাত্রই সকলকে ভালোবাসার এমন প্রবৃত্তি তৈরি হয় যে, সকলকে না ভালবেসে থাকা যায় না। সকলকেই আত্মার আত্মীয় বলে ‘বোধ’ হয়। গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ ছিলেন পরমপ্রেমিক-মহাপ্রেমিক-অপার্থিব প্রেমের অধিকারী ! তাই তো গুরুমহারাজ সকলকে সম্বোধন করতেন – “প্রিয় আত্মন্” বলে। যে কাউকে চিঠি লিখলে, চিঠিতে সম্বোধন করতেন – “অভিন্ন হৃদয়েষু” ! এই অপার্থিব প্রেমের অধিকারী হ’ন অবতার পুরুষেরা বা উচ্চকোটির মহাপুরুষেরা এবং পরম প্রেমময়ী মাতৃকাশক্তির প্রকাশেরা। আমরা সারদা মায়ের জীবনীতে পাই যে, তিনি নিকট-দূর, ভক্ত-অভক্ত, নারী-পুরুষ, শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকেই সন্তানজ্ঞানে অকাতরে প্রেম বিতরণ করতেন। যারা সেইসময়ে শ্রী শ্রী মায়ের কাছাকাছি থাকতো বা তাঁকে কাছ থেকে দেখতো, তারা প্রত্যেকেই অবাক হয়ে যেতো এই ভেবে যে, একজন নারী – যিনি আর পাঁচজনের মতো খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন, স্নানাদি-শৌচ করছেন – যাঁর আর পাঁচজনের মতো মাঝে মধ্যে শরীর খারাপও হোচ্ছে – যিনি আত্মীয়-স্বজন-পরিবার-পরিজনের ব্যথায় সময় সময় কাতরও হোচ্ছেন – সেই মায়ের মধ্যে প্রকৃত মাতৃত্ব, ‘সর্বংসহা ভাব’ এবং ‘বিশ্বজনীন প্রেম’ কিভাবে ক্রিয়াশীল হোতো !
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য অর্থাৎ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা এই ধরনের ঈশ্বরের পূর্ণ অবতারের সান্নিধ্যে যারা আসতে পেরেছিল, তারাই সেই অপার্থিব পরম প্রেমের স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহাজনদের লেখা গ্রন্থ থেকে আমরা তাঁদের সেই অপার্থিব প্রেমের কথা জানতে পারি – অন্তর্মুখী হয়ে কেউ কেউ হয়তো একটু-আধটু স্পর্শও পেতে পারি ! পরম প্রেমময় ভগবান বা ঈশ্বরের অবতারদের লীলার কথা স্মরণ-মনন, পঠন-পাঠন করলেও প্রেমের স্পর্শ অনুভূত হয় ! নাহলে তাঁদের লীলার কথা পড়তে পড়তে বা শ্রবণ করতে করতে চোখে জল ভরে আসে কেন ? শরীরে রোমাঞ্চ জাগে কেন ? মনের অবশ-বিবশ অবস্থা হয় কেন ?
যাইহোক, থাক এখন এসব কথা। আমরা আবার ফিরে যাই গুরুমহারাজের কথায় – দেখি সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের একেবারে শেষভাগে উনি আর কি কি বলেছেন ! গুরুজী বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – স্মরণ রেখো, প্রেমের ছোঁয়ায় প্রেমের আবির্ভাব আর হিংসা হোতে হিংসার আবির্ভাব। স্বার্থ হোতে দ্বেষ ও সমস্ত রকমের অশান্তির উৎপত্তি। প্রেমে ক্রুরতা-করুণাভাব ধারণ করে, ভয়-ভীতি – মৈত্রীভাব ধারণ করে, অস্থিরতা-চপলতা – শান্ত-স্নিগ্ধভাব ধারণ করে।” আমাদের সমাজে চলতি কিছু কিছু কথার প্রচলন রয়েছে, যেমন – “সঙ্গ দোষে শতগুণ নাশে !” আবার রয়েছে – “সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ (নরকবাস)!”– সুতরাং এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, মানুষের জীবনে সৎসঙ্গ লাভের খুবই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গুরুমহারাজ ও সেই কথাই আমাদের মনে পাড়িয়েছেন – তাই বলেছেন – ‘ (মহাপ্রেমিকের) প্রেমের ছোঁয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনে প্রেমের আবির্ভাব ঘটে যায় এবং (হিংসক ব্যক্তির) হিংসার স্পর্শে মানুষ হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে৷’
তাছাড়া গুরুমহারাজ আরো বলেছেন যে, মানুষের মনোজগতে যে দ্বেষ-বিদ্বেষ ভাব সৃষ্টি হয় সেইটি এবং তাছাড়া মানুষ যত রকমের মানসিক অশান্তিতে ভোগে – সেই সবকিছুর মূলে রয়েছে মানবের স্বার্থ। এই স্বার্থপূরণের আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে অশান্ত করে তোলে এবং সে নানাবিধ অশান্তির শিকার হয়। কিন্তু মানবের জীবনে একবার প্রেম প্রকটিত হয়ে গেলে ঐ মানুষ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কারণ প্রেমের আবির্ভাবে মনের মধ্যে অবস্থিত ক্রূরতা বা ক্রূরভাব—করুণাভাবে, ভয়-ভীতি— মৈত্রীভাবে এবং অস্থিরতা-চপলতা – শান্ত-স্নিগ্ধ ভাবে পরিণত হয়। এ বড় অপূর্ব কথা !! এই কথাগুলির দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে, দস্যু রত্নাকর কিভাবে বাল্মিকী হয়েছিলেন, পাষণ্ড জগাই-মাধাই কিভাবে পরমবৈষ্ণবে পরিণত হয়েছিলেন !
এই প্রসঙ্গেই এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” স্বার্থান্ধ পশুমানবকে স্বার্থমুক্ত সহজ অবস্থায় নিয়ে যেতে হোলে – প্রেমের দ্বারাই তা সম্ভব। তীব্র ভালোবাসা সমস্ত কিছুকে রূপান্তর করতে সক্ষম৷ কয়লা তার কালিমার রূপান্তর ঘটিয়ে যখন আলোকোজ্জ্বল হীরকে পরিণত হয়, তখন আর তাতে যেমন কালিমার লেশমাত্র থাকে না – সমস্ত কালিমা অদৃশ্য হয়ে যায়, ঐরূপ কামনা বাসনা স্বার্থবিজড়িত পশুমানবের মধ্যেও ভগবৎপ্রেমের আবির্ভাবের সাথে সাথে সমস্ত রকম স্বার্থের মলিনতা অদৃশ্য বা দূরীভূত হয়, আর তখনই সে মহাপ্রেমিকে বা সহজ মানবে পরিণত হয়।৷”