শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল। আমরা গুরুমহারাজ বিরচিত গ্রন্থ সহজতা ও প্রেম-এর একেবারে শেষের দিকে ‘প্রেম’ বিষয়ক কথায় ছিলাম। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – হৃদয়ে কণামাত্র স্বার্থবুদ্ধি থাকলে ভগবৎ প্রেমরূপ অমৃতলাভ হয় না। তোমার সাথে পরমেশ্বরের সম্পর্ক হলো সহজ ভালোবাসার। তিনি প্রাণের প্রাণ, হৃদয়ের হৃদয়, আত্মার আত্মা। একমাত্র তিনিই আপনজন। দন্ডের ভয়ে বিহ্বল হয়ে তাঁকে ভালোবাসা নয়, কিংবা কাল্পনিক স্বর্গ সুখভোগের লালসায় তাঁকে ভালবাসা নয়, আকুল প্রেমের মদিরা পান করো – সমস্ত রকম ভীতি ও ইন্দ্রিয় লালসা অদৃশ্য হবে। প্রেমের মত্ততা উপস্থিত হলে প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ এবং ভক্ত ও ভগবান একীভূত হয়ে যায়।৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! আমাদের ‘প্রেমিক’ (প্রকৃত) হবার সাধ গুরুমহারাজের একটিমাত্র কথাতেই মিটে গেল ! কারণ উনি বললেন যে, ‘ হৃদয় কণামাত্র স্বার্থবুদ্ধি থাকলে ভগবৎ প্রেমরূপ অমৃতলাভ হয় না।’ তাহলে আমাদের মতো অতি সাধারণ মানবদের আর মৃত্যুলোক ছেড়ে অমৃতলোকে যাওয়া আর হয়তো হবে না। কারণ আমাদের যে ষোলআনা স্বার্থবুদ্ধি ! পরার্থপরতা আর আমরা আত্মস্থ করতে পারলাম কই ? সেক্ষেত্রে কণামাত্র স্বার্থবুদ্ধি থাকলেও প্রেমলাভ যে সম্ভব হবে না – তাহলে আমাদের ন্যায় দুর্বল মানবেরা কখনই সেই অপ্রাকৃত চিন্ময় প্রেমের রাজ্যে পৌঁছাতে পারবো না। সেইজন্য গুরুমহারাজ আমাদেরকে কিছু সহজ কৌশল শিখিয়ে দিয়েছেন। উনি বলেছেন যে, মানুষের ভাবনা-চিন্তার বদল ঘটলেই মানুষটিরও বদল ঘটে যাবে। স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও পরার্থপর মানবে রূপান্তরিত হতে পারবে ! তার জন্য কি করতে হবে – আমাদের ভাবনার বদল ঘটাতে হবে। আমাদেরকে ভাবতে হবে যে, ঈশ্বর বা পরমেশ্বর আমাদের দূরের কোনো বস্তু বা বিষয় নয় – তিনি আমাদের অত্যন্ত কাছের, অত্যন্ত আপন। তিনি আমাদের প্রানের প্রান, হৃদয়ের হৃদয়, আত্মার আত্মা !
গুরুমহারাজ আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন যে, বিভিন্ন ধর্মমতে যে রয়েছে – পরমেশ্বর আমাদের ইহজগতের কর্মফলের দন্ডদাতা। সেই দন্ডের ভয়ে তাঁকে ভালোবাসা নয়, সমস্ত রকমের ভীতি এবং কাল্পনিক স্বর্গসুখের প্রলোভন (যা ইন্দ্রিয় লালসা চরিতার্থেরই নামান্তর) একেবারে দূরীভূত হয়ে যাবে যদি মানবের ভাবনার পরিবর্তন হয় এবং মানুষ প্রেম-মদিরা পানের জন্য আকুল হয়ে ওঠে ! যে স্থিতি লাভ করা আমাদের কাছে অসম্ভব ছিল – তা সহজসাধ্য হয়ে যায়, কারণ তখন আর প্রেমিক (অর্থাৎ সাধারণ মানব বা সাধক) এবং প্রেমাষ্পদ (অর্থাৎ পরমেশ্বর)-এর মধ্যে আর কোনো ভেদ ভাব থাকে না । একে অপরের সাথে মিলেমিশে একীভূত অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
আমরা আবার ফিরে যাই গুরু মহারাজের পরবর্তী কথা গুলিতে ! ভালবাসার সংজ্ঞা দিয়েছেন উনি, এবং বলেছেন” প্রিয় আত্মন্ যা তোমায় খর্ব করে না, তাই ভালোবাসা । ভালোবাসা অপর কাউকেই খর্ব করে না, তা (ভালোবাসা) তোমাকে মহান করে এবং অপরকে মহিমান্বিত করে !” কি সুন্দর প্রেম বা ভালোবাসার সংজ্ঞা আমরা পেলাম বলুন তো !! ‘যা আমায় খর্ব করে না’ অর্থাৎ আমাকে ছোটো করে না বা হেয় করে না_ যা শুধুই আমাকে মহান করে, মহিমময় করে– তাই ভালোবাসা ! সাধারণভাবে জাগতিকভাবেও আমরা দেখি যে, মা তাঁর সন্তানকে যেরূপ নিঃস্বার্থ ভালোবাসেন, নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়ান, নিজে কষ্ট-দুঃখ-আঘাত সহ্য করেও তাঁর সন্তানের একটু সুখের ব্যবস্থা করে দেন, সন্তানের বিপদে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিজে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন_ এগুলি বাইরে থেকে দেখলে মনে হোতেই পারে যে, মা বোধহয় নিজে ছোটো হয়ে, কষ্ট সয়ে তাঁর সন্তানকে বড় করছেন ! কিন্তু আদতে তা নয়_ এখানে মা ত্যাগের মহিমায়, ভালোবাসার মহিমায় আরো মহিমময়-আরো মহীয়সী হয়ে উঠেছেন এবং সন্তানকে(ছোটো অবস্থায়)-ও প্রত্যাশাবিহীন স্নেহ দান করে
মহান করেছেন ! এটা জেনে রাখা ভালো যে, সমাজের সব ক্ষেত্রেই এই একই নিয়ম বলবৎ থাকে। এইরূপ যে ত্যাগ, এইরূপ ভালোবাসা_ তা শুধু নিজেকেই মহান করে না, যাকে ভালবাসা হয়_ তাকেও মহিমান্বিত করে।
এইবার গুরুমহারাজ প্রেমের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারীদের কথাও উল্লেখ করেছেন এবং তাদের প্রকৃতি কিরূপ হয় তার বর্ণনায় বলেছেন_ ” হামবড়া দাম্ভিক ব্যক্তিদের মধ্যে নিজের অসার অহং-কে প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা দেখা যায়। এইজন্য তারা অসহিষ্ণু এবং ক্রুঢ় হয়ে পড়ে । নিজেকে বিকৃত স্বভাব-বিশিষ্ট উন্মাদে পরিণত করে তোলে!”_ কি সাংঘাতিক ব্যাপার দেখেছেন !! আমাদের মধ্যেই এই সমস্ত হামবড়া, দাম্ভিক ব্যক্তিরা রয়েছে, যারা শুধুই নিজের নিজের অহংকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাতেই মত্ত ! সে তারা সাধু-সন্ত, গৃহী-সংসারী, সাধক-ব্রহ্মচারী, স্বধর্মী-বিধর্মী যে-ই হোক না কেন_ আমাদের মতো সাধারণ মানুষজনেদের বেশিরভাগই এই দলে পড়ে যাবো । কিন্তু সকলেরই তো একটা কথা মানা উচিত যে,” আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয় । লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয় !” নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মত আহাম্মকি আর হয় না ! এতে ঈশ্বর‌ও রূষ্ট হ’ন, আবার জগত সংসারের মানুষের কাছেও ওই ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় । তাছাড়া গুরুমহারাজ আরো বললেন যে, ‘এরা ভীষণ অসহিষ্ণু হয় এবং ক্রূঢ় হয় । আর শেষে বিকৃত স্বভাব উন্মাদে পরিণত হয় ।’ কিন্তু সেটাও তো খুবই দুঃখের কথা ! ভগবৎ-ভক্ত হয়ে কোনো মানুষ শেষ জীবনে উন্মাদে পরিণত হবেই বা কেন ? এই কথাগুলোও সাধকদেরকে ভাবা উচিত এবং ঈশ্বরের প্রতি সদাসর্বদা শরণাগত থেকে, সেই ভাবেই নিজের জীবনকে গড়ে তোলা উচিত ।।