শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ওনার লেখা সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের একেবারে শেষভাগে এসে পৌঁছেছি। এখন আমরা দেখি গুরুমহারাজ আমাদের কল্যাণের নিমিত্ত আরো কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – তোমাদের দোষকে নির্মল করো, অন্তরকে পবিত্র ও নির্মল করো, ভালবাসার মদিরা পান করো এবং তীব্র আবেগে সবাইকে ভালোবাসতে থাকো। তাহলেই অন্তরের গভীরে প্রেমের দরজা খুলে যাবে। শুধু স্বার্থের বন্ধনে ওই দরজার কপাট বন্ধ হয়েছে। ভালবাসার তীব্র আঘাতে ওই স্বার্থ-বন্ধন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে৷ প্রেমের দুয়ার খুলে যাবে, অনুভব করবে আনন্দ, পরমেশ্বরের অপার করুণা !”
পাঠকবৃন্দ, দেখেছেন ! আগেই বলা হয়েছিল না – গুরুমহারাজের প্রতিটি কথায় আমাদের জন্য প্রেম যেন ঝরে ঝরে পড়ছে ! আবার প্রমান পেলেন তো ! আহা – গুরুজীর কি প্রচেষ্টা আমাদেরকে একটু একটু করে টেনে টেনে তোলার অসম্ভব প্রচেষ্টা !! উনি আমাদের মধ্যেকার সমস্ত দোষগুলি (যেগুলি আমাদের স্বভাব বা সংস্কার থেকে আসে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকেও আমরা প্রাপ্ত হই)-কে নির্মল করে তুলতে আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের দোষগুলি যেন ‘মল’ বা নোংরা আবর্জনা, এগুলিকে লুপ্ত করাই হোলো ‘নির্মল’ হওয়া ! একেই তো পবিত্রতা বলে। যে কোনো মানুষ, মনের কালিমা-কলুষ মুক্ত হোলেই পবিত্র হোতে পারে। আর যিনি শরীরে এবং অন্তঃকরণে একেবারে পবিত্র হয়ে গেছেন_ তখন সেখানে অবশ্যই ভগবৎশক্তির প্রকাশ ঘটে যাবে। কারণ সকলের অন্তরের অন্তঃস্থলে তো সেই অন্তর্যামীই রয়েছেন ! আয়নায় ‘মল’ বা ময়লা জমলে যেমন প্রতিচ্ছবি ভালো দেখা যায় না (বা একেবারেই দেখা যায় না), তেমনি আমাদের ন্যায় সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে অন্তঃকরণ মল বা ময়লা যুক্ত হওয়ায় সেখানে ভগবৎশক্তির স্ফুরণ ঘটে না। অন্তরের মল অপসারিত হোলেই আত্মসূর্য্যের প্রকাশ ঘটে ! আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই (অন্তর্জগতে) প্রেমের রাজ্য রয়েছে, কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই এতো স্বার্থপর যে, স্বার্থের বন্ধনে পড়ে ঐ প্রেমরাজ্যের কপাট বন্ধ হয়ে রয়েছে। মানবের অন্তরে ভালোবাসা বা প্রেম জাগ্রত হোলেই তার আঘাতে স্বার্থবন্ধন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। আর তখনই প্রেমের দুয়ার খুলে যায় এবং পরমেশ্বরের করুনার অনুভব হয়। যাইহোক, এরপরে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন, সেই দিকে আলোকপাত করা যাক। উনি এরপরে বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – স্মরণ রেখো – টাকা দিয়ে ভালোবাসা বিক্রি হয় না, তা মুদিখানার দোকানে কেনা বস্তু নয় যে কেনা-বেচা হবে। ‘এই বিশ্বটা একটা মুদিখানার দোকান’ – এইরূপ কখনো ভেবো না। ভালোবাসা কোনো পুরস্কারের আশা পোষণ করে না – শুধু আপনাকে নিবেদন করে, কিছু প্রত্যাশা করে না।৷” প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের এই কথাগুলির কতোটা গভীরতা তা হয়তো আমরা সাধারণ মানুষেরা ধরতেই পারবো না ! আমরা বাস্তব জগতে, যাত্রায়, নাটকে, সিনেমার সংলাপে প্রায়শঃই শুনতে পাই যে, ‘ভালোবাসা টাকা-পয়সার বিনিময়ে পাওয়া যায় না বা বিক্রি হয় না’! কিন্তু গুরুমহারাজ যেভাবে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ‘ভালোবাসা মুদিখানার দোকানের মাল নয় যে কেনা-বেচা হবে’! – এটির মধ্যেই গভীরতা লুকিয়ে রয়েছে ! উনি আরও স্মরণ করিয়েছেন যে, এই জগৎসংসারকে একটি ‘মুদির দোকান’ ভাবাটাও ভুল বা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয় ! এককথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, যেখানে প্রকৃত ভালোবাসা – সেখানে লেন-দেন, আদান-প্রদান, লাভ-লোকসান ইত্যাদি দ্বন্দ্বাত্মক বিষয় সমূহের কোনো স্থান নাই ! ‘প্রকৃত ভালোবাসা’ কোনোরূপ স্বার্থবন্ধনেই আবদ্ধ নয় – এটি পুরোপুরি স্বার্থবিহীন বা নিঃস্বার্থপরতা। যেখানে প্রেমাস্পদের প্রতি প্রেমিকের পুরোপুরি আত্মনিবেদন থাকে – তাই ভালোবাসা। এর বাইরে যা কিছু সম্পর্ক তার মধ্যে একটু-আধটু হোলেও স্বার্থ বিজড়িত থাকে। একমাত্র প্রকৃত ভালোবাসাতেই প্রেমিক প্রেমাস্পদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করে না ! যা প্রত্যাশাবিহীন – তাই ভালোবাসা ! এরপর গুরুমহারাজ এই ব্যাপারটাকেই আরো clear করার জন্য বললেন – ” ভালোবাসা স্বার্থবুদ্ধি নামক বৃক্ষটির মূলে তীব্র আঘাত হানে। ঐ আঘাত সংকীর্ণ কামনা-বাসনা জড়িত স্বার্থের অবলুপ্তি ঘটায়। এইজন্য আত্মনিবেদনের সুর বাজতে থাকে।” কি সুন্দরভাবে গুরুমহারাজ ক্রমটি বোঝালেন ! স্বার্থবুদ্ধিরূপ বৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করতে পারে একমাত্র ভালোবাসা বা প্রকৃত প্রেম। এই আঘাতে মানবের সংকীর্ণ কামনা-বাসনা জড়িত স্বার্থের অবলুপ্তি ঘটিয়ে দিতে পারে – আর তখনই মানবের (সাধকের) জীবনে ঠিক ঠিক আত্মনিবেদনের ভাব জাগ্রত হয়। সুতরাং এটা বোঝা গেল যে, মানবের জীবনে পরম লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যতগুলি step অতিক্রম করতে হোক না কেন – এর প্রথম শর্তই হোলো ভালোবাসা। যে জীবনে প্রেম প্রকটিত হোলো না – সেই জীবনে আধ্যাত্মিক উত্তরণ ঘটানো অসম্ভব। প্রেমহীন মানব শক্তিমান, অর্থবান, শিক্ষিত, যশস্বী ইত্যাদি অনেক কিছুই হোতে পারে – কিন্তু তার বিবেকের জাগরণ অথবা চেতনার উত্তরণ ঘটবে না – ঘটতে পারে না ! গুরুমহারাজ এক জায়গায় বলেছেন – “প্রেমহীন মানব জগতে সবচাইতে বড় দুর্ঘটনা !” কিন্তু সমাজের বেশিরভাগ মানুষই (অর্থাৎ আমরা প্রায় সকলেই) তো প্রেমহীন। তাইতো জগতে শুধু দুর্ঘটনাই ঘটে চলেছে। আর ঘটেও চলবে আরও বহুদিন ! যতদিন না সমাজের বেশিরভাগ মানুষ প্রেমের পথে আসবে – ততদিন মানবসমাজ শুধুমাত্র নানারকম দুর্ঘটনার-ই সম্মুখীন হবে অর্থাৎ মানবে মানবে হানাহানি, হিংসা, রক্তপাত-ই ঘটতে থাকবে_ পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে, শান্তির সঙ্গে সকলে একসাথে এই সমাজ মিলেমিশে বাস করার উপযোগী হয়ে উঠবে না !