শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের লেখা সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের প্রেম বিষয়ক কথার একেবারে শেষ অংশে। প্রকৃত প্রেম কি, প্রেমের অভাবে মানবের কি দশা হয় এবং প্রেমের স্ফুরণে মানবজীবনের কি কি পরিবর্তন লক্ষিত হয় – ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গুরুজী আলোচনা করেছেন। প্রেম সম্বন্ধে এরপরে উনি বলেছেন – ” ‘প্রেম’ অন্তর্জগতের অনুভবলব্ধ এবং অকারণ, কথা তাকে ব্যক্ত করতে পারে না। কারণ ‘ভাব’ এবং ‘ভাবালুতা’ দুটি ভিন্ন অবস্থা। ‘ভাব’ অনুভবগম্য বা উপলব্ধিসঞ্জাত, ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও অপ্রকৃত মাধুর্য। কিন্তু ভাবালুতা দর-দামের হিসাব-নিকাশ বা লাভ-লোকসানের জট পাকায় – কল্পনাময় বহু কথার জাল রচনা করে, আর চাওয়া-পাওয়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আশা-নৈরাশ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে।”
দেখুন কথাতেই বলা হয় প্রেমভাব, ভক্তিভাব ইত্যাদি ! সেই কথাকেই গুরুমহারাজ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন – ‘ভাব’ ও ‘ভাবালুতা’র পার্থক্য নিরূপণ ক’রে ৷ প্রেমকে অন্তর্জগতে অনুভব করা যায় কিন্তু এটি অকারণ, অর্থাৎ প্রেমে কোনো পাত্রা-পাত্র, উচ্চ-নীচ, আপন-পর ইত্যাদির ভেদভাব কাজ করে না। কোনরূপ কারণ ছাড়াই প্রেম একপাত্র থেকে অন্যপাত্রে বিতড়িত হোতে পারে – তাই প্রেম অকারণ ! আর ‘ভাব’-কেও গুরুমহারাজ অন্তর্জগতের-ই এক বিশেষ অবস্থা হিসাবে বর্ণনা করেছেন, সেটিও অনুভবগম্য বা উপলব্ধিসঞ্জাত এবং যা ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল ও অপ্রাকৃত মাধুর্যময়। কিন্তু ‘ভাবালুতা’ যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে সদাই ক্রিয়াশীল, এই ভাবালুতাই যত অনিষ্টের মূল – এটিই আমাদের মধ্যে দামী বস্তু বা কমদামী বস্তুর ভেদ সৃষ্টি করে, লাভ-লোকসানের হিসাব করতে বাধ্য করে। এই ভাবালুতা থেকেই আমরা সাধারন মানুষেরা নানান কথার জাল রচনা করি এবং চাওয়া-পাওয়ার বন্ধনে আবদ্ধ হই। এই ভাবালুতা থেকেই আমাদের মধ্যে আশা বা নৈরাশ্যের জন্ম হয় এবং আমরা তাতেই হাবুডুবু খেতে থাকি। যাইহোক, এরপর আমরা দেখি গুরুমহারাজ মানবকল্যাণের নিমিত্ত আরও কি কি সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – তোমার ভালবাসার বাগিচায় জীবনরূপ বৃক্ষে প্রেমের ফুল ফোটাও। এতে আত্ম-অনুভবরূপ ফল অবধারিত (ফলবে) – এই সম্বন্ধে তুমি নিঃসংশয় হোতে পারো ! কিন্তু সাবধান ! বাগিচার মধ্যে স্বার্থবুদ্ধিরূপ কাঁটা যেন না থাকে। থাকলে ঐগুলিকে সমূলে উৎপাটন করাে, কিঞ্চিৎ মূলও যেন অবশিষ্ট না থাকে ! তা না হোলে সমস্ত ব্যাপারটাই ব্যর্থতায় পরিণত (পর্যবসিত) হবে।” আহা ! এতো সুন্দর কাব্যকথা আগে কখনো শুনেছি কি আমরা !! পরম করুণাময় ভগবান স্বামী পরমানন্দ কি মধুর করে এই কথাগুলি বলেছেন ! কি সুন্দর উপমা সহকারে আধ্যাত্মিক রহস্যের কঠিন কঠিন কথাকে ব্যক্ত করেছেন! মানবের জীবনকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন গুরুমহারাজ, তাই বলেছেন ‘জীবনরূপ বৃক্ষ’ ! আর ‘ভালোবাসা’ হোলো সেইসব বৃক্ষ সমন্বিত বাগিচা। তার মানে আমরা এটা সহজেই বুঝতে পারছি যে – ‘প্রেম’ সর্বব্যাপক, ক্ষুদ্রতা-সংকীর্ণতার সেখানে কোনো স্থান নাই। তাই এক একটি জীবনকে উনি ‘বৃক্ষ’রূপে উল্লেখ করেছেন – যেখানে ভালোবাসাকে বলা হয়েছে ‘বাগিচা’ ! কিন্তু বাগিচায় অনেক বৃক্ষ থাকলেও যেমন যতক্ষণ পর্যন্ত না সেইসব বৃক্ষে প্রস্ফুটিত পুষ্পের শোভা দেখা যায় বা সুমিষ্ট জীবনদায়ী ফল না ফলে – ততক্ষণ বাগিচার সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয় না, তেমনি ‘ভালবাসা’-র বাগিচায় (universal) জীবনরূপ বৃক্ষে প্রেমের ফুল ফুটলে তবেই সেই ‘জীবনে’র (individual) সার্থকতা, তখনই সেই ‘জীবন’ শোভামণ্ডিত হয়ে ওঠে। সেই ‘জীবন’কেই ‘মহাজীবন’ বলা হয়। এঁরাই তাদের জীবনে প্রস্ফুটিত প্রেম-পুষ্পের সৌরভে আরও বহু জীবনকে আকর্ষিত করতে পারে এবং তাদের জীবনকেও সৌগন্ধে ভরপুর করে তোলে। কিন্তু গুরুমহারাজ মানবজীবনে শুধুমাত্র ‘প্রেমরূপ’ পুষ্প ফোটার কথাই বলেন নি, ফুল থেকে যে ফল পাওয়া যায় তার কথাও বলেছেন! আর সেই ‘ফল’-লাভ হোলে মানবজীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য আত্ম-অনুভব বা আত্মোপলব্ধি অথবা আত্মবোধ ! গুরুমহারাজ আমাদেরকে নিঃসংশয় হোতে বলেছেন, উনি বলেছেন যে, ‘জীবনবৃক্ষে প্রেমরূপ পুষ্প প্রস্ফুটিত হোলেই ‘আত্ম-অনুভব’ (আত্মবোধ)-রূপ ফল ফলবে – এটা অবশ্যম্ভাবী’। কিন্তু উনি যে ব্যাপারটায় আমাদেরকে বারবার সতর্ক করেছেন – তা হোলো ‘স্বার্থবুদ্ধি’ বিসর্জন দেওয়া। ‘স্বার্থবুদ্ধি’-কে উনি বাগিচার কাঁটাগাছ রূপে উল্লেখ করেছেন। এই স্বার্থবুদ্ধিরূপ কাঁটাগাছকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে ! কারণ দু-একটা মূল অবশিষ্ট থেকে গেলে হয়তো সেখান থেকে আবার ফেকড়ি বেরোতে পারে ! সাধকের জীবনে ঐ স্বার্থবুদ্ধি-ই তাকে আবার সাধন-জগৎ থেকে টেনে মোহের জগতে বা মায়ার জগতে আবদ্ধ করে ফেলে।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” আধ্যাত্মিক জগতে উত্থান-পতন বলে কোনো কথা নাই।” ওনার কথা অনুযায়ী সাধন জীবনে কেউ ওঠেও না, কেউ নামেও না – কিন্তু যেন চলার পথে কেউ কেউ বিশ্রাম নিতে শুরু করলো বা কেউ হয়তো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলো। তারপর আবার চলা, চরৈবেতি – চরৈবেতি – চরৈবেতি ! এই চলা কতদূর ? যতদিন না পরম লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায় – “প্রাপ্য বরান্‌ নিবেধিতঃ।”
যাইহোক, গুরুজীর কথাতেই ফিরে আসি। উনি বললেন যে, স্বার্থবুদ্ধি ত্যাগ না করলে সাধকের জীবনে প্রেমলাভ হয় না এবং প্রেমলাভ না হওয়া পর্যন্ত চরম বা পরম লক্ষ্যে পৌঁছানোও যায় না ! Horrizentaly শুধু এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে ঘুরে বেড়ানোই হয় – Vertical movement হয় না, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না !!