শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের লেখা সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের একেবারে শেষ পর্যায়ে, যেখানে গুরুমহারাজ ‘প্রেমে’র প্রকৃত সংজ্ঞা, এর বিস্তার, প্রেমের অভাবজনিত ফল – ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আমাদের পূর্বের আলোচনার পর থেকে এখন আবার ওনার করা পরবর্তী আলোচনায় ফিরছি ! এরপর উনি বলেছেন – “প্রেম সম্পূর্ণ স্বাধীন, সহজ আনন্দ বিগলিত তরল-উল্লাস। ভাষা তাকে প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে – তা জড়ত্ব নয় – পরমানন্দঘন সহজ স্থিতি। সুতরাং প্রেম অব্যক্ত অর্থাৎ কোনোকিছু তাকে প্রকাশ করতে পারে না, কিন্তু সবকিছু তারই প্রকাশ।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! প্রেমের নিত্যনতুন সংজ্ঞা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই অবগত হোচ্ছেন ! এইরূপ সংজ্ঞা একমাত্র বোধিব্যক্তি ছাড়া আর কার দেবার ক্ষমতা রয়েছে বলুন তো ? কি অপূর্ব সুন্দর কাব্যিক ভাষার বহিঃপ্রকাশ – “প্রেম সম্পূর্ণ স্বাধীন, সহজ আনন্দ বিগলিত তরল-উল্লাস !” এই কথাগুলির কি সত্যিই আমরা সাধারন মানুষেরা কোনোদিন ব্যাখ্যা করতে পারবো ? ‘প্রেম সম্পূর্ণ স্বাধীন’– এইটা আমাদের বোধগম্য ঠিকই কিন্তু তার পরের কথাগুলো ? সেসব কথা তো আমাদের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ গুরুমহারাজ কি অনায়াস ভঙ্গিমায় বললেন – “(প্রেম) সহজ আনন্দ বিগলিত তরল-উল্লাস !” তাহলে কথাটা দাঁড়ালো এই যে, প্রেম সম্পূর্ণ স্বাধীন, এটি সহজ আনন্দে বিগলিত তরল উল্লাস ! কিন্তু ‘সহজ আনন্দে বিগলিত তরল উল্লাস’ – ব্যাপারটা ঠিক কিরকম !! এর উত্তর কে দেবে ? একমাত্র বোধি ব্যক্তি ছাড়া কি এইসব কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব ? কারণ ‘উল্লাস’ কথাটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত কিন্তু ‘আনন্দ বিগলিত তরল উল্লাস’- এর অনুভব তো দুর-অস্ত, ধারণা করাই আমাদের পক্ষে দুষ্কর !!
তবু আমাদের সৌভাগ্য এই যে, আমরা অনেকেই অন্ততঃ এ যুগের যুগপুরুষ, পরমপ্রেমময়-করুণাময় ভগবান স্বামী পরমানন্দের অপার্থিব প্রেমের স্পর্শ লাভ করেছি, স্বয়ং শ্রীমুখ থেকে উচ্চারিত (এবং গ্রন্থাকারে লিখিত) এই সমস্ত কথা শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছি–এইটুকুই চরম সান্ত্বনা !
যাইহোক, এবার আমরা আবার ফিরে যাবো গুরুমহারাজের কথায়। দেখা যাক্ আমাদের জন্য আরো কতো নতুন নতুন কথামালা সেই পরম বোধিব্যক্তির শ্রীমুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে ! এরপর উনি ‘প্রেম’ সম্বন্ধে বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – প্রেম অব্যক্ত বেদনা ! ঐ অব্যক্ত বা অমূর্ত বেদনারই ব্যক্ত হবার প্রয়াস হতেই সমস্ত বিশ্বসংসারের উৎপত্তি ! সুতরাং বেদনার ভিতরেই রয়েছে সৃষ্টির প্রয়াস ! অমূর্ত বা অব্যক্তের মূর্ত বা ব্যক্ত হবার প্রয়াসেই আনন্দময় বিশ্বসংসাররূপে প্রতিভাসিত হোচ্ছে !”
দেখেছেন,– গুরুমহারাজ আবার একটা নতুন আঙ্গিকে প্রেমের স্বরূপ ব্যাখ্যা করলেন ! “প্রেম অব্যক্ত বেদনা”–কি সাংঘাতিক কথা ! তাহলে প্রেম মানে শুধু আনন্দ নয় – বিগলিত উল্লাসও নয়, এটি ‘বেদনা’ও বটে ! যে বেদনা ‘অব্যক্ত’!! কিন্তু এই অব্যক্ত বেদনা ও অমূর্ত বেদনাও প্রকাশ হবার জন্য উন্মুখ ! এর প্রকাশ হবার প্রয়াস থেকেই এই সমস্ত জগৎসংসারের উৎপত্তি – এ তো আরো সাংঘাতিক এবং বিশাল ভারী ভারী কথা !
আমাদের বুদ্ধির দৌড় বা আমাদের মনোজগতে ধারণ ক্ষমতার দৌড় কি অতদূর পৌঁছাতে পারবে ? বোধহয় না ! তাই এই ব্যাপারে একটু ভাসা-ভাসা জ্ঞানই না হয় থাক, আমাদের মধ্যে যিনি বা যাঁরা অন্তর্জগতে ডুব দিয়ে অন্বেষণ শুরু করেছেন — তাঁরা বোধহয় ঐ কথাগুলির অনুভব বা উপলব্ধি অথবা বোধ করতে পারেন ! তবে আমাদের মতো অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে এই ভেবে যে, ‘বেদনার ভেতরেই রয়েছে সৃষ্টির প্রয়াস !’
তাহলে দাঁড়ালোটা কি ? প্রেম-ই অব্যক্ত বেদনা – আর সেই বেদনা যখন ব্যক্ত হোতে চায় – তখনই জগৎসংসারের সৃষ্টি হয়, কারণ সৃষ্টির প্রয়াস নিহিত রয়েছে ঐ বেদনার ভিতরে। তাছাড়া গুরুমহারাজ আরো বলেছেন যে, ‘ওই প্রেম থেকে বা অব্যক্ত বেদনা থেকে ঐ বিশ্বসংসারের প্রতিভাস হয়েছে – তা আনন্দময়’ ! কি হোলো – বড্ড ধন্দে পড়ে গেলেন তো ! ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে মনে হোচ্ছে না ? প্রেম থেকে সৃষ্টি – যে প্রেম অব্যক্ত বা অমূর্ত বেদনা বই আর কিছুই নয়, আবার ঐ অব্যক্ত বেদনার ব্যক্ত হবার প্রয়াস থেকে যে বিশ্বসংসার সৃষ্টি হচ্ছে –তা আনন্দময় ! তাহলে দেখা গেল যে, প্রথমে প্রেম – আবার শেষে আনন্দ, কিন্তু মাঝে রয়েছে বেদনা ! এই বেদনাটুকু রয়েছে বলেই প্রেম এতো মহিমামন্ডিত এবং জগৎসংসারে দুঃখ-জ্বালা-যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও তা আনন্দময় !
এরপর গুরুমহারাজ এই ব্যাপারেই আরো বলেছেন – ” সুতরাং এই বিশ্বসংসার পরমানন্দময় পরমাত্মার প্রকাশ। ঐ জমাট বেদনাই নব সৃষ্টির প্রেরণা, ঐ প্রেরণা হোতেই জগৎসংসারের প্রকাশ হোচ্ছে। আর প্রকাশেই আনন্দ ! ঐ অব্যক্ত বেদনার ব্যক্ত হবার আনন্দেতে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপ জগৎ-সংসার আবর্তিত হোচ্ছে !”