শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত ও লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজ বিরচিত সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের একেবারে শেষ অধ্যায়ে। ভারতীয় অধ্যাত্মশাস্ত্র উপনিষদাদিতে রয়েছে – ” আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং পয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি।”– ‘আনন্দ হইতেই এই ভূতবর্গ (পঞ্চমহাভূত) জাত হয়, জাত হইয়া আনন্দের ধারা বর্ধিত হয় এবং অবশেষে আনন্দাভিমুখে প্রতিগমন করে ও আনন্দে বিলীন হয় !'(তৈত্তিরীয় উপনিষদ – ৩/৬)
আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি গুরুমহারাজও এই কথারই পুষ্টি করেছেন কিন্তু একটু অন্য আঙ্গিকে ! উনি বলেছেন – ” প্রেম(আনন্দের ঘনীভূত অবস্থা)-ই হোলো অব্যক্ত বেদনা, আর সেই বেদনার ব্যক্ত হবার প্রয়াস থেকেই বিশ্বসংসারের (পঞ্চভূত সমন্বিত) উৎপত্তি, যে বিশ্বসংসারতা আনন্দময়।” তাছাড়া উনি আরো বলেছেন – “ঐ অব্যক্ত বেদনার ব্যক্ত হবার আনন্দতেই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়রূপ জগৎ-সংসার আবর্তিত হোচ্ছে।” তৈত্তিরীয় উপনিষদের শ্লোকের অর্থকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে, আরো সহজ ও প্রাঞ্জল করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন গুরুমহারাজ ! আর দেবেনই তো – তিনি যে এই যুগের যুগপুরুষ ! তাইতো তিনি যুগোপযোগী করেই সবকিছুকে বিবৃত করেছেন। এবার আমরা দেখি উনি তাঁর সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের একেবারে শেষ stanza দুটিতে আরো কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – শুধুমাত্র স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তিরাই অপরের ব্যথা-বেদনা অনুভব করে না এবং ব্যথিতদের বেদনার প্রতি সহানুভূতি হারায় ! তারা সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও সংকীর্ণ সুখ-দুঃখের গণ্ডীতে নিজেদের মনকে আচ্ছন্ন রাখে। এরা ভীমরতি দশাগ্রস্থ, আত্মবিস্মৃত, অসহজ মানব !” এই কথাগুলি করুণাময় এবং পরম প্রেমময় ভগবান পরমানন্দে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন। উনি আগেই বলেছিলেন – মানবজীবনে প্রেমের প্রকাশের প্রধান অন্তরায় হোলো – স্বার্থবুদ্ধি ! আমাদের মধ্যে এই স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন বা স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে উনি বলেছেন যে, ‘এই ধরনের ব্যক্তিরা তার সমাজের, এমনকি তার পরিবারের সদস্যদের বা নিকট জনেদেরও ব্যথা-বেদনা অনুভব করতে পারে না এবং ব্যথিতদের বেদনার প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলে’ !
সত্যিই তো – স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তি কেনই বা অপরের বেদনায় ব্যথিত হবে বা অপরের দুঃখে কাতর হবে অথবা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে ? এমনটা হোলে তো সে ‘বিবেকী’ বা বিবেকপরায়ণ হয়ে যাবে ! আর যার বিবেক ক্রিয়াশীল সে তো স্বার্থবুদ্ধি থেকে অনেকটাই উপরে রয়েছে – সে তো অপরের দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণার সমব্যথী হয়ে থাকে ! এইভাবেই আমরা সমাজজীবনে দুইরকম বিপরীত চিত্র অহরহ দেখতে পাই ! একশ্রেণীর মানুষ কোনো না কোনো বাহানায় কোনো না কোনো স্বার্থবুদ্ধি (অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক) চরিতার্থ করার জন্য অক্লেষে অন্য কোনো ব্যক্তির বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিতে কসুর করে না ! আবার দেখা যায় সেখানেই কোনো অচেনা-অজানা ব্যক্তি ঐ রক্তাক্ত ব্যক্তিকে কোলে নিয়ে তার চোখেমুখে জল দেয়, তাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেয় ! এরপরের চিত্রটা যদি কল্পনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে – ঐ হাসপাতলের-ই ঐ পীড়িত ব্যক্তির অজানা-অচেনা ডাক্তারেরা, নার্সেরা এবং অন্যান্য কর্মচারীরা অত্যন্ত তৎপরতা, যত্নশীলতা ও সাবধানতার সঙ্গে সেই ব্যক্তির সেবা-শুশ্রূষায় লেগে যায়, তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়তো তারা ঐ ব্যক্তিকে বাঁচিয়েও তোলে !
তাহলে সমাজের ঐ দুই ধরণের চিত্রটা দেখা গেল তো ! এইবার আমাদেরকেও ভাবতে হবে আমরা নিজেরা কোন দলে পড়ি ! ওই স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের দলে – না, বিবেকী মানুষদের দলে অর্থাৎ যারা আর্ত-পীড়িত-দুর্বল মানুষদের সাহায্যার্থে সবসময় সহানুভূতিশীল, সেবাপ্রবণ, বিবেকপরায়ণ
তাদের দলে ?
সমাজে অবিবেকী, স্বার্থান্ধ, নিষ্ঠুর, হীনবুদ্ধি লোকের সংখ্যাই অধিক – অবিবেকী মানুষেরাই সমাজের বেশিরভাগ স্থান বা অংশ দখল করে বসে রয়েছে – কিন্তু তাতে কি ? তাই বলে কি আমি আমার অগ্রগতি, আমার আধ্যাত্মিক পথে পথ-চলা বন্ধ করে দেবো ? নিশ্চয়ই না ! এখন এই মুহূর্তে পৃথিবী যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে – তাতে সত্যি সত্যিই ভালো মানুষদের, আধ্যাত্মিক মানুষদের, বিবেকী মানুষদের খুবই সংকটকাল ! তারা অনেককিছুই এমন দেখছে – শুনছে যে, তাদের অন্তর্জগত ব্যথাতুর হয়ে উঠছে – তারা এইগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হতে চাইছে – কিন্তু সামাজিকতার ভয়ে, নিজের অস্তিত্ব (শারীরিক) রক্ষার সংকটে ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে, চুপ করে রয়েছে ! অপেক্ষা করছে উপযুক্ত সময়ের – কখন ঐশ্বরীয় শক্তি(কোনো না কোনো মানুষের বেশে এসে) যে কোনোভাবে এই দুর্দিনের অবসান করে !!
কিছু সৎসাহসী ব্যক্তি অন্যায়ের বা অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েছে – লড়াইও চলছে সৎ বনাম অসৎ-এর লড়াই, বিবেকী বনাম স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের লড়াই ! কিন্তু জেনে রাখতে হবে – এই লড়াই চিরকালই রয়েছে ! যেটা আগে বলা হোতো দেবা-সুরের সংগ্রাম অথবা সত্য রক্ষার লড়াই বা ধর্মরক্ষার লড়াই – সেই লড়াই-ই আজ আমরা সমাজে দেখছি অন্যভাবে – অন্যরূপে ! এই লড়াই এখনই শেষ হবে না – এই লড়াই চলতে থাকবে আরো অনেকদিন ! কতদিন চলবে ? যতদিন না আমাদের মনুষ্য সমাজের অধিকাংশ সদস্যরা অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষেরা বিবেকপরায়ন না হয়ে উঠতে পারছে ! আর সেইটা হয়ে ওঠার জন্যই এই যুগের যুগপুরুষ স্বামী পরমানন্দের শিক্ষাকে আরো বেশি বেশি করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে – যাতে এই সমাজের মানুষ তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করে বিবেকী হয়ে উঠতে পারে, স্বার্থবুদ্ধি পরিত্যাগ করতে পারে, প্রেমের স্পর্শ পেতে পারে।৷