শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজের লেখা সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ের একেবারে শেষের চ্যাপ্টারে গুরুমহারাজ যে কথাগুলি বলেছেন – আমরা এখন সেইগুলিই তুলে ধরছি। উনি বললেন – ” প্রিয় আত্মন্ – তুমি যদি আমায় জিজ্ঞাসা করো – পরমেশ্বর কি? তাহলে আমি এককথায় বলবো – ‘তিনি মূর্তিমান অখন্ড প্রেম!’ আমি বলবো – ‘তাঁর ঐ অসহ্য প্রেমে যে একবার পাগল হয়েছে – যার ঐ উন্মত্ত প্রেমের আঘাতে সমস্ত স্বার্থাভিমান চুরমার হয়ে গেছে – যার কামনা-বাসনা ঐ প্রেমসমুদ্রের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে – সে আর কি বলতে পারে ? পরমেশ্বর মূর্তিমান অখন্ড প্রেমস্বরূপ – অব্যক্ত বেদনা-সঞ্জাত অপ্রাকৃত আনন্দ,– এর বেশি বলতে যাওয়া ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! দেখেছেন এই যুগের যুগপুরুষের যুগোপযোগী কথার কি মাধুর্য – ছোটো ছোটো কথার কি ব্যাপ্তি – কি বিস্তার ! সমগ্র পৃথিবীতে চলতে থাকা সহস্র সহস্র ধর্মমতগুলিতে পরমেশ্বর সম্বন্ধে কতো কথা – কতো ব্যাখ্যা, কতো তর্ক-বিতর্ক, কতো গন্ডগোল-মারামারি-হানাহানি ! কিন্তু যুগপুরুষ স্বামী পরমানন্দ এককথায় পরমেশ্বরের সংজ্ঞা দিলেন – ” তিনি মূর্তিমান অখন্ড প্রেম !” এই কথার পরে আমরা বেশ বুঝতে পারছি যে, সত্যি সত্যিই আমরা মানুষেরা চেতনার Level-এ এখনো কতো নিচে রয়েছি, বলা যায় একেবারে তলানিতে রয়েছি ! যে পরমেশ্বর ‘মূর্তিমান অখন্ড প্রেম’– তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা মারামারি করে মরছি, খুন-জখম-অগ্নিকাণ্ড-লুটপাট-নারীদের উপর অকথ্য নির্যাতন বা অত্যাচার করে চলেছি ! তাহলে আর আমরা এখনো নিজেদেরকে “মানুষ”– এই অবস্থায় উন্নীত করতে পারলাম কই ? আমরা তো এখনো মনুষ্যেতর অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছি – তাই নয় কি ? আপনারাই বলুন – (যারা গুরুমহারাজের লেখাগুলো নিয়মিত পড়ছেন – তাদের কথা বলা হোচ্ছে) কথাগুলি বিচার করে বলুন !!
গুরুমহারাজ পরমেশ্বর সম্বন্ধে বা ঐ ‘মূর্তিমান প্রেম’ সম্বন্ধে আরো বললেন যে, ঐ যে এককথায় পরমেশ্বরকে প্রকাশ করার ব্যক্তিও এ জগতে খুবই কম ! কারণ এই ধরনের কথা তাঁরাই বলতে পারেন যাঁরা ঐ অসহ্য প্রেমে পাগল হয়েছেন, ঐ উন্মত্ত প্রেমের আঘাতে যাঁর বা যাঁদের স্বার্থাভিমান-স্বার্থবুদ্ধি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, যাঁদের জীবনের কামনা-বাসনাও ঐ অপার্থিব প্রেম সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেছে ! সুতরাং আমরা এটা বেশ বুঝতে পারছি যে, স্বার্থবুদ্ধি–কামনা-বাসনা এইসবগুলি থাকতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কোনদিনই ঐ অপার্থিব – অপ্রাকৃত প্রেমের স্পর্শ পেতে পারবে না।
প্রকৃত প্রেমিক যাঁরা – তাঁরা পরমেশ্বরকে ‘মূর্তিমান প্রেম’ ছাড়া আর কিই বা বলতে পারেন ? গুরুমহারাজ বলেছেন – পরমেশ্বরকে ‘সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপ’ অথবা ‘অব্যক্ত বেদনা-সঞ্জাত অপ্রাকৃত আনন্দ’ ছাড়া তার বেশি বলতে যাওয়াটা ব্যর্থ প্রয়াস হয়ে যায় ! অথচ দেখুন – আমরা সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মমতের ধর্মবিশ্বাসী-ধর্মান্ধ-ধর্মভীরুরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সেই ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ পরমেশ্বরকে কেমন নিজের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে বসি ! সেই অখণ্ড প্রেমস্বরূপকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা অহরহ সমাজে কতই না ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা ছড়াই ! আমরা পরস্পর পরস্পরকে প্রতিনিয়ত ছোটো করি, মানবতার চরম অপমান করি ! কি মূর্খ আমরা – কি অজ্ঞান আমরা – কি নিদারুণ শিশু চেতনায় রয়েছে আমাদের চেতনার Level ! সাধে কি আর গুরুমহারাজ বারবার বলতেন – ” পৃথিবীগ্রহের মানুষের মানসিক Level, চেতনার Level এখনো শৈশব অবস্থায় রয়েছে ! যেন সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে !”
গুরুমহারাজের কাছ থেকে এই সমস্ত কথা শুনে তখন (যেহেতু প্রথম প্রথম যখন যেতাম, তখন আমরা ছিলাম তরুণ, সবে যৌবনে পদার্পণ করেছি) খুবই রাগ হোতো, গুরুজীর নানা কথার প্রতিবাদও করে বসতাম ! মনে মনে হোতো – আমরা বর্তমান মানুষেরা তো যথেষ্টই উন্নত, আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নানান বিষয়ে গবেষণা – ইত্যাদিতে কত এগিয়ে গেছি। চন্দ্র-অভিযান, মঙ্গল গ্রহ অভিযান হয়ে চলেছে, জল-স্থল-অন্তরীক্ষে মানুষের যাতায়াত সুগম হয়েছে এবং সেইসবের রহস্য ধীরে ধীরে আমাদের কাছে প্রকাশিত হচ্ছে – তাহলে ‘আমরা শৈশব অবস্থায় আছি’– এমন কথা উনি বলছেন কেন ? এর উত্তরে তখন উনি বলেছিলেন যে, এইরকম বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি , জড় বিজ্ঞানের শাখাসমূহের গবেষণার কাজ পৃথিবীগ্রহে এর আগেও অনেকবার হয়েছে – কিন্তু অনুন্নত চেতনার জন্যেই মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি, ঝগড়া, হানাহানি, যুদ্ধ ইত্যাদি করে নিজেরা নিজেরাই সেইগুলিকে ধ্বংস করেছে। সুতরাং এখনও যে সমস্ত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি, নগরসভ্যতার রমরমা ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে – কিছুদিনের মধ্যেই মানুষেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, যুদ্ধ করে সেই সবকিছু নষ্ট করে ফেলবে এবং নিজেরাই নিজেদেরকে মেরে ফেলবে।
তারপর? তারপর কি হবে? আবার নতুন করে বনে-জঙ্গলে বসবাসকারী অল্প কিছু মানুষেরা সমাজজীবন শুরু করবে, তারাই ধীরে ধীরে আবার নগরসভ্যতা গড়ে তুলবে, আবার কোন না কোন issue (ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক – ইত্যাদি) তৈরি করে আবার লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। তাহলে এর শেষ কোথায়? মানবের পরিণতি কি হবে? এইজন্যেই যুগে যুগে যুগপুরুষরা আসেন বর্তমান মানুষদেরকে বোঝাতে যে, ‘এই’ প্রবাহ – ‘এই’ আবর্ত চলতেই থাকবে, চলতে চলতে একটু একটু করে সকলের চেতনা উন্নত হবে। কিন্তু যুগপুরুষের শিক্ষা জীবনে গ্রহণ করে যারা নিজেদের চেতনার Level-কে তুলে ধরতে পারবে, আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত হয়ে উঠতে পারবে – তারা এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে বেড়িয়ে যেতে পারবে – আর তাদের এই জগৎজ্বালায় জ্বলতে হবে না। তারজন্যেই গুরুমহারাজ শেষ কথা বললেন – ” প্রিয় আত্মন্ – (তোমরা) সৎ হও – সুন্দর হও – প্রেমিক হও, দেখবে আনন্দ প্রতিষ্ঠিত – পরমেশ্বরের করুণা অপার।৷”