শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরামানন্দের কথা (কথিত ও লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা আগের দিনেই ওনার স্বহস্ত লিখিত প্রথম গ্রন্থ সহজতা ও প্রেম -এর শেষ লাইনের কথা বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই গ্রন্থেই গুরুমহারাজের নির্দেশে চরৈবেতি কার্যালয়ের সম্পাদক স্বামী স্বরূপানন্দ মহারাজ পরিশিষ্টতে গুরুজীর লেখা গোটাকয়েক কবিতা সংযোজন করে দিয়েছিলেন। আমরা সেইসব কবিতার মধ্যে প্রথম দুটি অসাধারণ কবিতার কথা একটু আলোচনা করবো। এই দুটি কবিতা মনোযোগ সহকারে পাঠ করলেই যে কোনো মানুষ বুঝতে পারবে যে, স্বামী পরমানন্দ নিশ্চিতভাবেই এই যুগের যুগপুরুষ ছিলেন এবং ঈশ্বর স্বয়ং ভাগবতী-তনু ধারণ করে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
যাইহোক, আমরা ওনার প্রথম কবিতার কথাগুলিতে যাই – যেখানে উনি আমাদের মতো মৃত বা জড়বৎ সাধারণ মানুষদের চেতনায় অপ্রাকৃত প্রেমের চাবুক মেরে মেরে, আমাদেরকে জাগানোর চেষ্টা করেছেন। আসুন আমরা সেই মহামানবের সেই সব অসাধারণ কবিতার স্বাদগ্রহণ করে ধন্য হই :~
চরৈবেতি
————-
“প্রিয় আত্মন্‌–
তুমি চলছো–তাই জীবিত, তাই তুমি জীবন।
জড়েরা মৃত–আত্মবিস্মৃত, জড়েরা মৃতের সমতুল্য।
এই বিশ্ব-সংসার স্রোতের মতো প্রবাহমান,
একই উৎস হোতে সুর, ছন্দ ও তালে প্রবাহিত হয়ে
ঐ মহাসঙ্গীতের সুরে বিলীন হোচ্ছে।
আর ঐ মহাসংগীত বেজে চলেছে অনাদি অনন্তকাল ধরে।
সময় তার নিকটে তুচ্ছ, ক্ষণিক–স্বপ্নমাত্র।
তুমি সেই অবিনাশী সত্তার প্রকাশ আর এই মহাবিশ্বের
প্রতিটি কণায় কণায় ওই মহাসঙ্গীতের সুর বেজে চলেছে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরু মহারাজ যে চলার কথা বলেছেন, তা হাঁটা-চলা বা walking নয় – এই চলা চেতনার উত্তরণ এবং বিবেকের জাগরণ। “আমিই আত্মা”– এই বোধ থেকে বিচ্যুতি-ই আত্মবিস্মৃতি ! গুরুমহারাজ অন্যত্র বলেছেন “আত্মবিস্মৃতিরূপ মহামৃত্যু!” আমরা সাধারণ মানুষেরা যেহেতু আত্মবিস্মৃত (আমরা ব্রহ্ম থেকেই এসেছি, আমরাও ব্রহ্মস্বরূপ–কিন্তু সেই কথা ভুলে গেছি–এটাই আত্মবিস্মৃতি) তাই আমরা মৃত বা মৃতের সমতুল্য ! একই উৎস (ব্রহ্ম) হোতেই এই বিশ্বসংসারের সমস্তকিছু প্রকাশিত।
গুরুমহারাজ সেই ব্যাপারটিকে বর্ণনা করেছেন – যেন নির্দিষ্ট সুর, ছন্দ ও তালে এক মহাসঙ্গীত অনন্তকাল ধরে সমগ্র বিশ্বসংসারের প্রতিটি কণায় কণায় বেজে চলেছে ! গুরুমহারাজ আরো বলছেন – প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জীবনও সেই মহাসঙ্গীতেরই সুরে বিধৃত।
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন:–
“প্রিয় আত্মন্–তোমার হৃদয়ের নিভৃত কুঞ্জে
ঐ সঙ্গীতের সুর বাজছে।
তুমি উদ্দিপ্ত করো জীবনের প্রতি সুতীব্র ভালবাসা।৷
তুমি জেগে ওঠো জীবনের বোধে।
তোমার জীবনসঙ্গীত তরঙ্গে তরঙ্গে–মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে উঠুক।
হে সাক্ষাৎ জীবনদেবতা, আলিপ্সার অবিলতামুক্ত তুমিই সেই প্রথম প্রেম।
অন্ধ, জড়, সুষুপ্তি হোতে উঠে আসা তুমিই সেই প্রথম প্রজ্ঞা বা জ্ঞান।
বিস্মৃতির অতল হৈতে উঠে আসা তুমিই সেই আনন্দস্বরূপ পরম প্রকাশ।
তুমিই সেই অমৃত, পরম আনন্দময় জীবন।
তুমি সেই মহাপ্রেমানন্দস্বরূপ–সার্বজনীন ও সাম্যের
সঙ্গীত দুই হস্ত তুলে গেয়ে চলো।
তুমিই মহাকালের চেতনা।”
গুরুমহারাজ বলেছেন – সকলের হৃদয়ের নিভৃত স্থানে (অন্তরের অন্তঃস্থলে) সেই পরমেশ্বররূপ মহাসঙ্গীতের সুর বেজে চলেছে। প্রতিটি জীবনেরও জীবনসঙ্গীত সুরের মূর্ছনায় মুখরিত হোতে পারে যদি আমরা (সাধক) আমাদের জীবনের প্রতি সুতীব্র ভালোবাসা আনতে পারি এবং জীবনের বোধে জাগ্রত হোতে পারি। গুরুমহারাজ আমাদের সকলকে উদ্দীপ্ত করেছেন, উৎসাহিত করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়ে আমাদেরকে সাক্ষাৎ ‘জীবনদেবতা’র মর্যাদা দিয়েছেন এবং ‘আলিপ্সা’-র আবিলতা মুক্ত হোতে বলেছেন, আত্মবিস্মৃতির অতল থেকে উঠে আসতে বলেছেন, জড়ত্বের সুপ্ত অবস্থা থেকে উঠে আসতে বলেছেন। উনি প্রতিটি মানুষকে অসম্ভব মর্যাদা দিয়ে বলেছেন, প্রতিটি জীবন সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপ, প্রজ্ঞাস্বরূপ এবং আনন্দস্বরূপ। প্রতিটি জীবনকে উনি বলেছেন – অমৃতস্বরূপ ও আনন্দময় এবং উনি আরো বলেছেন, প্রতিটি জীবনই হোলো মহাকালের চেতনা !
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন –
“প্রিয় জীবন, তুমি পরমেশ্বরের অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ।
তুমিই সেই মহাজ্যোতি, পরমেশ্বরের প্রথম পরম প্রকাশ।
এই অন্ধকার সুপ্তির ভিতর তুমিই একমাত্র জীবিত।
জড়ের আবিলতা হোতে তুমি জেগে ওঠো।
হে চৈতন্যময়–তুমি জেগে ওঠো।”