গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ)-কে কেউ কি সম্পূর্ণভাবে জানে বা জানতে পারে ? গুরু মহারাজ সিটিং-এ আলোচনা প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন – “ভগবানের লীলা বোঝা ভার !” সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মূর্ত্তরূপকে বলা হয় ভগবান ! ওনার শরীর হ’ল – “ভাগবতী তনু ” ! এই ভাগবতী তনুধারী ব্যক্তি-ই ভগবান ৷ এনারাই লীলা করেন ৷ ভগবান রাম , ভগবান কৃষ্ণ , ভগবান বুদ্ধ , ভগবান শ্রীচৈতন্য , ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখেরা আগে আগে পৃথিবীগ্রহে লীলা করে গেছেন ৷ অতিসম্প্রতি লীলাশরীর ধারণ করে লীলা করে গেলেন ভগবান স্বামী পরমানন্দ ! এবার প্রশ্ন ভগবান স্বামী পরমানন্দের লীলার সমস্তটা কি কেউ জানে, বোঝে বা বলতে পারে ?
উত্তর একটাই — ” না ” ! কেউই সবটা জানে না ! কেউ তাঁর লীলার সবটা বলতে পারবে না !!!! পাঠককুল বলতেই পারেন – তাই আবার হয় নাকি ? ভগবানের কত বড় বড় ভক্ত , পার্ষদ , উত্তরসূরীরা আছে না ? – তারা সবটাই জানে ।
কিন্তু না – তারা জানে না ! জানা সম্ভব নয় বলেই জানে না ! ভগবানের লীলার সবটা একমাত্র ভগবান-ই জানেন! কারণ একমাত্র ভগবান-ই পূর্ণরূপে , পূর্ণজ্ঞানে – পূর্ণ ! বাকী কারও ওরূপটি হওয়ার উপায় নাই ! হলে – তিনিও তো ভগবান ! তিনি তখন আর ভক্ত , পার্ষদ , উত্তরসূরী নন !
বিস্তৃত আলোচনায় আসি । ভগবান যখনই শরীর ধারণ করেন তখন তিনি “অবতরণ” করেন (কোথা হতে সেটার ঠিক ধারণা আমার নাই !) , তিনি “জন্ম-গ্রহণ” করেন (‘জন্মগ্রহণ’ কথাটি বহুল প্রচলিত , কিন্তু গুরু মহারাজ বলেছিলেন একমাত্র অবতার পুরুষেরাই সজ্ঞানে জন্ম নেন – তাই এটাকেই ঠিক ঠিক জন্মগ্রহণ বলা হয় । বাকীরা তো জন্মায় – জন্ম ‘গ্রহণ’ করে না !) ! এই যে “জন্ম-গ্রহণ” , এটা তাঁর নিজস্ব ! এখানে কিন্তু কোন সাথী থাকে না ! কৃষ্ণ কথার পূর্বে যেমন প্রাক্-কথন থাকে(গৌরচন্দ্রিকা), ভগবানের শরীর ধারণের পূর্বেও তেমনি প্রাক্-ব্যাপার থাকে ৷ ভগবান পরমানন্দ যেমন বলেছিলেন হিমালয়ের দূর্গম কোন শিখরে সাতজন ঋষি উর্দ্ধবাহু হয়ে তাঁকে আবাহণ করেছিলেন ! বলেছিলেন – ” হে প্রভু ! এসো – এসো – এসো ! হে অমূর্ত্ত ! তুমি করুণার মূর্ত্তিতে নেমে এসো ধরণীর ধূলায় !” তখনকার লীলা ঐ কজন ছাড়া আর কে জানলো?
যাইহোক, তিনি তো এলেন, এবার শুরু হোল তাঁর গর্ভে থাকাকালীন লীলা ! সেখানে ভগবানের সাথী শুধু _মা, জননী ! তাও মা (গর্ভধারিনী) যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকেন – তখন তিনি লীলার সাক্ষী থাকতে পারেন না ! আর তাঁর মা জেগে থাকলেও গর্ভস্থ সন্তানরূপী ভগবান যতটুকু বোঝান , তিনি ততটাই বোঝেন !
এরপর শৈশবলীলা – সেখানে মা-বাবা ছাড়া পরিবারের কিছু লোকজন সাক্ষী ! হয়তো এরা ছাড়া কিছু প্রতিবেশী , কিছু আত্মীয়স্বজন ! শৈশবলীলার পর আসে বাল্যলীলা – সেখানে গোটাকয়েক বালক বন্ধু ভগবানকে বাল্যবন্ধু হিসাবে পায় ! তারা তাকে কাঁধে নেয় – আবার সময় সময় বালক ভগবানের-ই কাঁধে পা দিয়ে ওঠে , তাঁর পিঠে চেপে বেড়ায় !
কৈশোর এবং পৌগন্ড লীলায় আলাদা সাথী ! শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলায় সখ্য , বাৎসল্য , মধুর লীলার মতো লীলাগুলি এই বয়সে হয়েছিল । ভগবান পরমানন্দের ক্ষেত্রে এই সময়টা কেটেছে বনে-জঙ্গলে , পাহাড়ে-পর্বতে , ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় , গ্রামে-শহরে , পথে প্রান্তরে ৷ সেখানে কোথাও সাক্ষী দুজন নাগা-সন্ন্যাসী , কোথাও উলঙ্গ – উগ্র মহা-কাপালিক – মহা-ভৈরব – অঘোরীর দল ! আর বেশীরভাগ সময়েই তিনি একা ! একা ! আর একা !!
যৌবনের প্রারম্ভ কাটল – দিনের বেলায় Rural Electrification-এর কাজে ; আর রাতের বেলায় শ্মশানে , মন্দিরে , কবরস্থানে নিমগ্ন সাধনায় ৷ আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা সাথী , আলাদা আলাদা সাক্ষী ! একটু আধটু সাথী যারা , একটু আধটু সাক্ষী যারা তাদের কাছে যতটা স্মৃতি আছে , যতটা সঙ্গ আছে , যতটা স্পর্শ‍্য আছে তাতেই একটা জীবন , দুটো জীবন , শত-সহস্র জীবনের খোরাক হয়ে যাবে ! তাতেই আমাদের মতো সাধারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনের ছোট ছোট আধারে (পাত্রে) জায়গা আঁটছে না , সংকুলান হচ্ছে না – উপছে পড়ছে !
আর আমরা কিনা যাচ্ছি সেই বিরাট – বিরাট – বিরাট মহাজীবনের সম্পূর্ণটা বর্ণনা করতে !!! হায় রে মূর্খ ! কি মূর্খতা !!
যাইহোক , আসি সেই মহাজীবনের কথায় । এরপর উনি একদিন হঠাৎ করে ঘোষনা করলেন – “বাপু হে ! এতদিন তোমরা যাকে চিনতে, আমি আর সে রবীন নই , রবি নই , রবিনসন ক্রুশো নই , – তোমাদের দাদা, ভাই, বন্ধু, সখা _নই! আমি এখন ‘গুরু’, জগতের গুরু, জগৎগুরু! সকল ভক্তদের পিতা- মাতা- সখা- বন্ধু (এ বন্ধু ভবপারের বন্ধু)!
আগের আগের লীলায় সহচর-সহকারীরা আর এই লীলায় ঢুকতে চায় না _ঢুকতে পারে না! এখন অন্য সহকারী, অন্য সহচর! ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় রাখাল বালক, মা যশোদা, গোপরাজ নন্দ ঘোষ! কৈশোরে entry হোল রাধারানী এবং তার সখীদলের! সেখানে তাদের নিয়ে কত লীলা! কত কান্ড! কত বিরহ-কত মিলন! আর তাই নিয়ে কত কাব্য- কত সাহিত্য!
কিন্তু যেদিন অক্রুরের রথে চেপে শ্রীকৃষ্ণ চলে গেলেন মথুরায়, বৃন্দাবনের দিকে আর ফিরেও চাইলেন না। বৃন্দাবনের বৃক্ষ-লতা, পশু-পাখি, ভক্তকুল শুধু কাঁদতো! ভগবানের সাথে কাটানো সেই দিনগুলির মধুর স্মৃতিচারণ কোরতো _আর দুরের পথের পানে চেয়ে চেয়ে সময় কাটাতো_যদি কখনও তাদের প্রান প্রিয় প্রাননাথ ফিরে আসে! কিন্তু কই! ইতিহাস তো ফিরে আসার কথা কখনো বলে নি!!
তাই মথুরালীলা, দ্বারকালীলায় আর তাদের প্রবেশাধিকার ঘটে নি(শুধু বন্ধু সুদামার একটু ঘটনা শোনা যায়)!
দ্বারকালীলায় ভগবানের বিবাহ, সংসার জীবন, রাজা হয়ে রাজ্যপাট সামলানো নিয়েই কাটতো! সেখানে ভগবান মন্ত্রী – সান্ত্রী-সেনাপতি-রাজন্যবর্গ-পুত্র পৌত্রাদির সাথেই সময় কাটাতেন! ওরা তখন জানতো ভগবান তাদের!
আবার দেখুন _যেই কুরু-পান্ডবের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল _তখন ইতিহাস আমাদের দেখালো-“কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ”! সেখানে বৃন্দাবনের কেউ নাই, মথুরার কেউ নাই, দ্বারকার কেউ নাই! একা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!অবশ্য তিনি সবসময়ই একা! প্রয়োজনে বন্ধু বানিয়ে নেন! কুরুক্ষেত্রেও তাই নতুন বন্ধু, নতুন লীলা সহচর!
গুরুমহারাজ এই জন্যই বলতেন “শেষ নাই যার _শেষ কথা কে বলবে!!” (ক্রমশঃ)