শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত রচিত প্রথম গ্রন্থ সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের কথাগুলি তুলে ধরা শেষ কোরে ঐ গ্রন্থের পরিশিষ্টতে সংযোজিত দুটি কবিতার উল্লেখ এখানে করতে চাইছিলাম, তার মধ্যে প্রথম কবিতাটির (চরৈবেতি) অপার্থিব কথামাধূরী আপনারা আগের এপিসোডে পেয়ে গেছেন। এখন আমরা ওনার লিখিত দ্বিতীয় কবিতা “শৃন্বন্তু বিশ্বে”– কবিতাটির কথামালাগুলি এখানে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করবো।
“শৃণ্বন্তু বিশ্বে”
—————–
প্রিয় আত্মন্–
পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছি
মৃতদের নিমিত্ত।
জীবিতরা পূর্ব হোতে অনুগৃহীত।
আত্মবিস্মৃত মৃতেরা পুনরুজ্জীবন
লাভ করুক।
অমৃতস্য পুত্রাঃ–
হে অমৃতময় দিব্যজীবন ;
তুমি অমৃতের মূর্ত প্রকাশ।
তোমাতে এতো বিষাদ কেন ?
তুমি অমৃতের অধিকারী,
তবু কেন হাহাকার ?
কিসের অভাব তোমার ?
কি হারিয়েছে তুমি ?
সহজতা হারিয়েছে–
অসহযোগিতা তোমায় করেছে গ্রাস।
পড়েছ আত্মবিস্মৃতির কবলে।
ভ্রমাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবন,
আত্মবিস্মৃতি মহামৃত্যু
তোমাকে করেছে গ্রাস।
ওঠো – জাগো –
পুনরুজ্জীবন লাভ করো।
আমি অনন্ত জীবনের অধিকারী,
তোমায় জীবন প্রদান করব,
যে জীবন তোমার চির-আকাঙ্ক্ষিত
পরমের সঙ্গে করাবে মিলন।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের লেখা কবিতা পাঠ করলেন তো ! কবিতার কথাগুলি যেন নতুন আঙ্গিকে লেখা উপনিষদ ! যেখানে সেই প্রাচীন ঋষিদের বোধসঞ্জাত মহাবাণী – চরম ও পরম সত্যের বাণী, অরণ্যের যজ্ঞবেদীর ধূমের সাথে নিত্য উচ্চারিত হোতো – সেই একই বাণী পূর্ব-বর্ধমান জেলার মেমারী থানার অন্তর্গত, অতি ক্ষুদ্র গ্রাম বনগ্রামের এক প্রান্তে, একটি ছোট্ট মাটির তৈরি কুঁড়েঘর থেকে উদ্গীত হয়েছিল। এই বাণীগুলি যেন সেই একই শাশ্বত চিরন্তন সত্যকেই পুনরায় নতুন আঙ্গিকে প্রকাশের প্রয়াস !
এই কথাগুলি বলার মাধ্যমে একটা নতুন কথা উনি আমাদেরকে শোনালেন – আর তা হোলো, “পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছি – মৃতদের নিমিত্ত !” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব একবার বলেছিলেন, ” নবাবী আমলের মুদ্রা কোম্পানী আমলে চলে না।”– সময়ের সাথে এবং যুগ বিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতি – পরিবেশ ইত্যাদি সবকিছুই পরিবর্তিত হয়। কিছু কিছু বস্তু, বিষয় বা ব্যক্তি নতুনভাবে- নতুন আঙ্গিকে সেজে ওঠে, আবার অনেককিছু কালের গর্ভে হারিয়ে যায় ! মহাপুরুষগণের বা অবতারপুরুষগণের পৃথিবী গ্রহে বারবার আগমনটাও হয় যুগের সাথে, পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে।
সেইজন্যেই তো তাঁরা যুগপুরুষ – যুগোপযোগী করে সেই চিরন্তন শাশ্বত-সনাতন সত্যকে প্রকাশ করতেই তো তাঁদের আগমন। কারণ তাঁদের এই পৃথিবীতে শরীরধারণের একমাত্র উদ্দেশ্যই হোলো মানবের কল্যাণ–জগতের কল্যাণ। মায়া-মোহরূপ অজ্ঞানতায় আবদ্ধ থাকা জীবসকলকে একটু একটু করে উত্তরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া !
কিন্তু তার জন্য কতো বড় মহাশক্তির প্রয়োজন বলুন তো ! সমগ্র জীবজগৎকে অন্ধকারময় অজ্ঞানতার জগৎ থেকে ঠেলে ঠেলে আলোর (জ্ঞানালোক) দিকে নিয়ে যাওয়া তো প্রায় অসম্ভব (প্রায়) কার্য ! কিন্তু সেই প্রায় অসম্ভব কার্যই যুগে যুগে যুগপুরুষেরা সম্ভব করে চলেছেন। স্বামী পরমানন্দ হোলেন এই যুগের যুগপুরুষ – তাইতো উনি ঐ কবিতায় বলেছেন – “পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছি!” আর মৃত কারা – আমাদের ন্যায় সাধারণ মানুষেরা, আবার কারা ?! কারণ ঐ যে উনি বললেন – “আত্মবিস্মৃতি-ই মৃত্যু!” আমরা তো প্রায় প্রত্যেকেই আত্মবিস্মৃত ! ‘আমি-ই সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ বা আত্মস্বরূপ’– এই স্মৃতি, এই বোধ আমাদের কোথায় ? সিংহশিশু হয়েও ছাগলের দলে মানুষ হোলে যেমন সে ঘাস-পাতা খেয়ে মরে – আমাদেরও তো সেই একই অবস্থা ! মায়া-মোহ, কামনা-বাসনা ইত্যাদির জালে ফেঁসে গিয়ে – ‘পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদছে!’
যাইহোক, এরপর গুরুমহারাজ বললেন –
” সিদ্ধান্তের কথা বলবো না,
সিদ্ধান্ত অনেক শুনেছো।
উপদেশ দেব না,
উপদেশ অনেক পেয়েছ।
না–কোন বাদ নয়–
বাদগ্রস্থ জীবনে
বিবাদ উপস্থিত হয়,
বাদের কথা বলবো না।
জীবনের কথা বলবো–
যা তুমি হারিয়েছ,
তা আমি খুঁজে পেয়েছি
তোমায় প্রদান করব পুনরুজ্জীবন৷
জীবনের কথা বলবো–
সত্যই জীবন, ত্যাগই জীবন।
সত্য-ত্যাগ-প্রেম-শান্তিই জীবন।
মৃত কে ?
যে জীবনে সত্য নেই।
যে জীবনের ত্যাগ নেই।
যে জীবনে প্রেম নেই।
যে জীবনে শান্তি নেই।
সত্য-ত্যাগ-প্রেম-শান্তি
যেখানে প্রকঠিত নয়,
সেখানে ধর্ম নেই–
সেখানে জীবন নেই।
জীবনের কথা বলবো–
সদাচারে সত্য মূর্ত,
মিথ্যাচারে নয়।
সদাচারই জীবন।
জীবনের কথা বলবো–
পরোপকারে ত্যাগ মূর্ত,
স্বার্থপরতায় নয়।
পরোপকারই জীবন।
জীবনের কথা বলবো–
ভালোবাসায় প্রেম মূর্ত
পাশবিকতায় নয়।
ভালোবাসাই জীবন।
জীবনের কথা বলবো–
সংযমে শান্তি মূর্ত,
অসংযমে নয়।
সংযমই জীবন।
প্রিয় আত্মন্–
যা হারিয়েছ তা প্রাপ্ত হও।
পুনরুজ্জীবিত হও।
আনন্দ প্রতিষ্ঠিত–
পরমেশ্বরে মহিমা অপার।৷”