গুরু মহারাজের (স্বামী পরমানন্দ) উপস্থিতিতে ন’কাকাদের বাড়ীর কালীমন্দিরে কার্ত্তিক মাসের কালীপূজার কথায় আমরা ছিলাম ৷ কিন্তু যেহেতু মাঝের গ্রামের ৺পঞ্চানন ব্যানার্জীর প্রসঙ্গ উঠে গেল – তাই ন’কাকার সাথে ওনার সম্পর্কের কথা বলে নেওয়া যাক । গুরু মহারাজ, তৃষাণ মহারাজের বাবার (৺পঞ্চানন ব্যানার্জী) এবং পুতুলমার সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছিলেন ৷ তৃষাণ মহারাজের বাবা অন্তিমকালটা (জীবনের শেষ ২/৩ বছর) বনগ্রাম আশ্রমেই ছিলেন । প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে ন’কাকা বাঁড়ুজ্জে মশাই (৺পঞ্চানন ব্যানার্জী)-এর ঘরে যেতেন । ওখানে বসত চায়ের আসর ! গঙ্গাবাবু, গোপাল ডাক্তার, ন’কাকা এবং মাঝে মাঝেই আমি ওই ঘরে গিয়ে হাজির হতাম ৷ বাঁড়ুজ্জে মশাই-এর দেখাশোনা করতেন মাধবী মা । উনি-ই চা করে দিতেন ( মাধবী মা এখন প্রায়ই করিমপুর আশ্রমে থাকেন, ওখানে রান্নাবান্না করেন ৷)। ন’কাকার আসতে একটু দেরী হলে বাঁড়ুজ্জে মশাই ছটফট্ ছটফট্ করতেন — ‘কই গো মাধবী মা, ন’কত্তা এল কই ?’ (ন’কাকাকে বাঁড়ুজ্জে মশাই ন’কত্তা বলতেন) ন’কাকা ওনার ঘরে (যে Building-টায় এখন তৃষাণ মহারাজ থাকেন, ঐ Building-এর নীচের একটা ঘরে পঞ্চানন ব্যানার্জী থাকতেন) যাওয়া মাত্রই বাঁড়ুজ্জে মশাইএর সে কি আনন্দ ! কত কথা বলতেন ! বাঁড়ুজ্জে মশাই-এর একটু শ্লেষ্মা-সর্দির ধাত ছিল ৷ কথা বলতে বলতেই কাশি আসতো – কিন্তু তবু ন’কাকার সাথে নানা কথা বলতেন ।উনি মমতা ব্যানার্জী (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, তখন সাধারণ নেত্রী মাত্র !)-কে নিয়মিত চিঠি দিতেন ! চিঠিতে’ অসুরদলনী দূর্গারূপে মমতার আবির্ভাব’– এই বলে আশীর্বাদ করতেন । ওনার মুখে শুনেছিলাম — মমতা ব্যানার্জী নাকি ওনাকে চিঠির উত্তর-ও দিতেন ! পঞ্চানন ব্যানার্জীর মূত্যুশয্যায় বর্ধমানে নার্সিংহোমে ন’কাকা দেখা করতে গিয়েছিলেন ৷ ওনার মৃত্যুর পর ন’কাকা প্রায়ই বাঁড়ুজ্জে মশাই-এর কথার প্রসঙ্গ টেনে এনে পুরোনো কথা আলোচনা করে বলতেন – “বাঁড়ুজ্জে মশাই সদাশিব প্রকৃতির লোক ছিলেন , সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন কিন্তু টাকা পয়সা রাখতে পারতেন না — ‘যত্ কে আয় – তত্ কে ব্যয়’ ! কোন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলেই তাকে সাহায্য করতেন ৷” গুরু মহারাজও সিটিং-এ বলতেন – “তৃষাণের বাবার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় বাজারের ওখানে এক চায়ের দোকানে। ওই দোকানে ওনার একটা ধার-বাকির খাতা খোলা ছিল – অনেকেই (যারা বদ লোক) তৃষাণের বাবার নামে চা-বিস্কুট খেয়ে ঐ খাতায় লিখে নিয়ে চলে যেতো ৷ এর ফলে মাসের মাইনে পেয়ে – সেই টাকার একটা বড় অংশ চায়ের দোকানে বিল মেটাতে খরচ হোত !” ন’কাকা আরও বলেছিলেন – “বাঁড়ুজ্জে মশাইদের একটা পারিবারিক সমস্যা চলছিল – বাড়ী-ঘর, জমি-জমা নিয়ে শরিকি সমস্যা ! মাঝে মাঝে এটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যেতো — মারধরও হোত। এইসবে খুবই দুঃখিত হয়ে বাঁড়ুজ্জে মশাই একদিন ‘মা কালী’র কাছে খুব প্রার্থনা করছিলেন, আর খুব কাঁদছিলেন । হঠাৎ ওনার দর্শন হয় যে ‘মা কালী’ প্রকট হয়ে ওনার কোলে একটা শিশুপুত্রকে ফেলে দেয় — যার গায়ে খুব লোম ছিল । তারপর মা বলেন – ‘এই নে ! এই ছেলেকে তোকে দিলাম ! এর থেকেই তোর পারিবারিক সমস্যা বা অন্য সব সমস্যা মিটে যাবে !’ সেই ছেলেই তৃষাণ ৷” ন’কাকার সাথে বনগ্রাম আশ্রমের ঐ ঘরে অর্থাৎ যে ঘরে বাঁড়ুজ্জে মশাই থাকতেন — ওখানে আমারও নিত্য যাওয়া-আসা ছিল ৷ ফলে এইসব অনেক কথা আমিও ওনার মুখে শুনেছিলাম ৷ বাঁড়ুজ্জে মশাইও ছিলেন কালীর উপাসক – মাতৃসাধক , আর ন’কাকাও মাতৃসাধক – মায়ের প্রিয় ছেলে ৷ এই দুজনের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোই লাগত । পঞ্চানন ব্যানার্জী থেকে থেকেই “মা পরমানন্দ” বলে উঠতেন ৷ শুনেছিলাম উনি মা কালীরূপে গুরুমহারাজকে দর্শন করেছিলেন। এক একদিন চায়ের আসরে বাঁড়ুজ্জেমশাই ন’কাকাকে বলতেন “বুঝলে ন’কত্তা! পুরো ‘চন্ডী’-টা আমি আসনে বসে এখনো মুখস্থ পাঠ করতে পারি। আসলে সারা জীবন তো এইসব নিয়েই কাটিয়েছি! তবে ন’কত্তা! মা আমাকে খুব কৃপা করেছে, জানো! মা আমাকে অনেক দিয়েছেঅনেককিছু দেখিয়েছে!” ন’কাকা ওনার সব কথাই শুনতেনআর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সব কথাতেই শুধু সায় দিয়ে যেতেন। এটা সবার জেনে রাখা ভালো গুরুমহারাজ বা ন’কাকা দুজনেই ছিলেন কিন্তু খুব ভালো শ্রোতা! এঁদের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারলে যে কি শান্তি হোত _ তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এইরকম একটা ঘটনা মনে পড়ছে সেইটা বলি। আমি তখন আশ্রমে থাকি। একদিন কাটোয়ায় ফিরব তাই দুপুরের খাবার পরেই গুরুমহারাজের ঘরের কাছে গিয়ে লাইন দিয়েছি। মোটামুটি ১০/১৫-জনের পরে গিয়ে দাঁড়ালামআমিই শেষ ব্যক্তি! দেখলাম স্বপন(বনগ্রাম আশ্রমের স্বপন ব্রহ্মচারী) গুরুমহারাজের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে যাতে সবাই যেতে পারে তার ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। আমার আগে একজন মোটাসোটা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিল, ফলে আমার আগে সেই ঢুকে গেল। পিছনে আর কেউ নেই দেখে স্বপন ব্রহ্মচারী আমাকে চুপিচুপি বলল “শ্রীধরদা! তুমি বেড়িয়ে আসার পর গুরুজীর ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিও। আমাকে ‘অমুক’ মহারাজ ডাকছে একটু আসছি।” আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি! ভদ্রমহিলার কথা আর শেষ হয় না! কিছু কিছু কথা আমার কানে আসছিল” জানেন তো গুরুজী! আপনাকে আমার ভগবান নারায়ণ বলে মনে হয়। আপনাকেই আমি জীবনের ধ্রুবতারা করে নিয়েছি। আমি সবাইকে আপনার কথা বলি।এখানে আসার কথা বলি। তবে জানেন তো – কেউ আসতেই চায় না! আসলে তারা তো আপনার মহিমা জানে না!”ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কথা! আমার বাস ধরার তাড়া ছিল তাই একটু অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু করার ই বা কি! অবশেষে একটা সময় এল যখন ঐ মহিলা গুরুমহারাজের ঘর থেকে বেরোল। আমি গুরুমহারাজের ঘরে ঢুকে_ ওনাকে প্রনাম করে প্রসাদ নিতে নিতে (গুরুমহারাজকে প্রনাম করলেই উনি যা হোক কিছু প্রসাদ দিতেন) ঐ মহিলার প্রসঙ্গ তুললাম“ভদ্রমহিলা এতক্ষণ ধরে আপনাকে কি বলছিল?” গুরুমহারাজ বললেন ” আমিও তো ওর কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।কি জানিস তো _আমাকে সবাই garbage ফেলার জায়গা বলে মনে করে। তাই যার যা মনে থাকে, সে সেগুলো আমার কাছে এসে উগড়ে দেয়। এও সেইরকমই দিল।”(ক্রমশঃ) জয় গূরূজী ।জয় ন’কাকা ।