গুরু মহারাজ শরীরে থাকাকালীন ন’কাকাদের বাড়ীতে কালীপূজার কথা বলার ছিল – এখন সেইসব কথা বলি ! তখন ১৯৮৪/৮৫ সাল – আশ্রমের একেবারে প্রথমদিক’ই বলা চলে ৷ তখন আগেকার কালীঘর (তখন ঠিক মন্দির ছিল না)! সেইসময় কার্ত্তিকমাসের কালীপূজার রাতে একবার ওখানে ছিলাম (পরে অবশ্য প্রতিবছরই যেতাম) । সারাদিন ধরে কালীপূজোর ব্যাপারটা – সেই প্রথম দেখেছিলাম ৷ অন্যান্য জায়গায় সাধারণতঃ কালীপূজা রাত্রেই হয় – বনগ্রামের মুখার্জী বাড়ীর কালীপূজার বিশেষত্ব এটাই যে ওখানে সকাল থেকেই হোম-যজ্ঞ, পূজা ইত্যাদি হয়েই চলে । তারপর সন্ধ্যার সময় অন্যান্যদের মতোই পূজা হয় । গাঙ্গুলী বাড়ীর (ন’কাকাদের পূজার অন্য শরিক) বুড়োমা যতদিন সুস্থ ছিলেন – ততদিন তিনি ঐ দিন ঢাকের তালে নাচতে নাচতে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতেন । কিন্তু আমি যখন বনগ্রামে গেলাম তখন ন’কাকার মা বুড়োমা এবং গাঙ্গুলী বাড়ীর বুড়োমা দুজনেই খুবই বৃদ্ধা ! গুরু মহারাজ বলতেন – ঐ দিনে বুড়োমার কুলকুন্ডলিনীর ক্রিয়া হোত বলেই — উনি অতক্ষণ ধরে প্রচণ্ড পরিশ্রমসাধ্য নাচ নাচতে পারতেন ৷ আমার ওনার নাচ দেখার সৌভাগ্য হয়নি ! কারণ তার ঠিক আগেই গুরুমহারাজ নিজে ওনার সাথে নেচে ওনাকে ঐ কাজ করা থেকে বিরত করেছিলেন।
সন্ধ্যার দিকে ন’কাকাদের বাড়ীর কালীপূজো যখন শুরু হোত, তখন গুরু মহারাজ(আশ্রমে থাকলে) মন্দিরের ভিতরে গিয়ে বসতেন ৷ তখন ঘরটা খুবই ছোট ছিল — ফলে থরে থরে সাজানো কাটাফলের নৈবেদ্য, পূজার উপকরণের ফাঁকে বসার জায়গা পাওয়া খুবই দুরূহ ছিল । দুজন পুরোহিতকে তো ভিতরে বসতেই হোত!
পরবর্ত্তীতে যখন গুরু মহারাজ কালীমন্দির (বর্তমানে যেটি দেখা যাচ্ছে) নতুন করে নির্মাণ করেছিলেন – তখন ভেতরকার Space-টা অপেক্ষাকৃত বড় হ’ল । সেই সময় একবার তপিমার বাবা (মুখার্জী বাড়ীর মেজোকর্ত্তা) আমাকে বলেছিলেন – যখন পূজা হবে তখন মন্দিরের ভিতরে ঢুকে আমার পাশে গিয়ে বসবি (উনি-ই তন্ত্রধারক ছিলেন অর্থাৎ পুঁথি বলে দিচ্ছিলেন আর গাঙ্গুলীবাবু পূজো করছিলেন – যদিও ঐ কাজটা বরাবর করতেন মাষ্টারমশাই দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) – দেখবি পূজার সময় কেমন Vibration ! এইসব (vibration) শব্দগুলির সঙ্গে তখন সবে সবে পরিচয় হচ্ছে ! আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের অনেকেই তখন ধ্যান-জপ করতে করতে অনেক কিছু অনুভূতি হয় — ফলে তারাও বলত। আর গুরু মহারাজের কাছে এই শব্দটা বারবার শুনে শুনে আমরা তখন অনেকটাই অভ্যস্ত ! তাই এই সুযোগ ছাড়লাম না ৷ সন্ধ্যার পূজো শুরু হবার পরে পরেই সামনের ভিড় ঠেলে (যদিও তখন অল্প ভিড় হোত) টুক করে ঘরে ঢুকে পড়তেই তপিমার বাবা (মেজোকর্ত্তা) আমাকে দেখে ইঙ্গিতে ওনার বাঁ পাশটা দেখিয়ে বসতে বললেন ৷ আমিও ঢুকে পরে জিনিসপত্র একটু সরিয়ে বসে পড়লাম ৷ ঘরে দীপের আলো – ধূপ-ধূনোর ধোঁয়া , মন্ত্রোচ্চারণের গমগমে ভাব –ইত্যাদিতে মন্দিরের ভিতরটা তখন মায়াময় হয়ে উঠেছে !
বাইরে থেকে মন্দিরের ভিতরে এসে বসার পর অর্থাৎ প্রাথমিক চঞ্চলতা – বিহ্বলতা – নতুন জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেবার অস্বস্তি – এইসব কাটানোর পর – এবার মায়ের মূর্ত্তির দিকে, নৈবেদ্যের সমারোহের দিকে – পুরোহিত মশাইয়ের দিকে — অর্থাৎ এককথায় ঘরের ভিতরকার সবকিছুর দিকে নজর বোলাচ্ছি ! হঠাৎ আমার হৃৎপিন্ড ছলাৎ করে উঠল – এই রে ! গুরু মহারাজ ওইদিকটার একটা আসনে চোখবুজে বসে (ঘরের বাঁদিকের কোণায় আমি বসে আর ডানদিকের কোণার দিকে ওনার আসন পাতা ছিল।) ! আমার Vibration বোঝার দফারফা ! আসলে তার আগে আমি জানতামই না – যে কালীপূজার সময় গুরু মহারাজ মন্দিরের ভিতরেই পুরো সময়টা বসে থাকেন । এবার আমি পালাতে পারলে বাঁচি ! কিন্তু সেটাও শোভা পায় না ! মন্দিরের উঠোনে ভিড়ও উত্তোরোত্তর বাড়ছে – আশ্রমের ভক্তসংখ্যা(যারা বাইরে থেকে আসত) তখন কম হোত, কিন্তু গ্রামের অনেকেই উপোস করে পূজো দিতে অাসতো এবং তারা পুষ্পাঞ্জলীও দিতো । ফলে মন্দির প্রাঙ্গনে ভিড় ঠিকই থাকতো । যাইহোক, এইসব বিবেচনা করে পালাতে পারলাম না পূজোর সময়টা আমি মন্দিরেই বসে থাকলাম! গুরু মহারাজের দিকে আড়চোখে বারেবারেই দেখছিলাম – কিন্তু উনি একবারও চোখ এদিকওদিক করেন নি, হয় স্থিরভাবে মা করুনাময়ীর পানে তাকিয়ে ছিলেন অথবা চোখ বন্ধ করে থাকছিলেন। পূজো চলতে চলতেই তপিমার বাবা একবার বাঁদিকে ঝুঁকে আস্তে আস্তে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “কি রে! Vibration কিছু টের পাচ্ছিস?” আমি আর কি বলি! সে রকম তো আলাদা করে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না! তবে মনে মনে মা করুনাময়ীর প্রতি প্রনাম এবং তপিমার বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিশ্চয়ই জানিয়েছিলাম। কারন জীবনে একবারের জন্য হলেও কালীপূজার রাত্রে মন্দিরের ভিতরে গুরুমহারাজের উপস্থিতিতে আমাকে বসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন! পূজো শেষ হয়ে গেলে এইবার প্রসাদ খাওয়ার পালা! ফলপ্রসাদ নিয়ে আমি আর অসীমদা (শ্রীরামপুরের) বাড়ির ভিতরে দাওয়ায় (যেখানে বসে আমরা রাত্রির সিটিং শুনতাম)বসে গেলাম খিচুড়ি প্রসাদ খেতে। দাওয়ায় এবং নিচের উঠোনে মিলিয়ে বহু লোকজন বসে খাচ্ছিল। ঐদিন গোটা গ্রামের লোকজনের নিমন্ত্রণ থাকে, তাই গাঙ্গুলী বাড়িতেও লোকজন খেতে বসেছিল। যাইহোক, আমরা খেতে বসার পরই দেখলাম গুরুমহারাজ উপরে(মাটির দেড়তলা) উঠে গেলেন ওনাকে ঐখানে খাবার দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দায়িত্বে ছিলেন গাঙ্গুলীবাড়ির মেজবৌ। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে সেই সময় গুরুমহারাজ হাত মুছতে মুছতে নেমে গেলেন এবং বাড়ির বড়দের উদ্দেশ্য করে “আসছি” বলে গটগট করে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন।
এরপরে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি আজও যখনই স্মরণে আসে তখনই লজ্জা পাই, নিজেই নিজেকে blame করি, মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে! ঘটনাটা বলি_!
আগেই বলেছি আমাদের খাওয়া তখন প্রায় শেষের দিকে শেষ item পায়েস দেওয়া হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময়ে গাঙ্গুলীবাড়ির মেজবৌ গুরুমহারাজের ভুক্তাবশেষ সহ এঁটো বাসনপত্র নিয়ে নিচে নেমে এলেন। আমার সাথে ওনার খুবই হৃদ্যতার সম্পর্ক থাকায় উনি খুব আনন্দ করে গুরুমহারাজের খাওয়া পায়েসের বাটি থেকে একটু তুলে নিয়ে আমাকে এবং অসীমদাকে দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলেন(কারন গুরুমহারাজের প্রসাদ বাড়ির সকলকে দিতে হবে)। কিন্তু তখনো আমার জন্ম-জন্মান্তরের ‘বামনাই’ সংস্কার!! অন্য কারো এঁটো খাওয়াটা তখনো আমি খুবই গর্হিত কাজ বলে মনে করতামতাই সেদিন ঐ প্রসাদ আমি খেতে পারি নি! এটা লজ্জার না অপরাধেরনা অন্যকিছু, তা আমি জানি না! অবশ্য এই ‘বামনাই’ উনি কাটিয়ে দিয়েছিলেন। পরে গুরুমহারাজের প্রসাদ ভক্তিভরে কত খেয়েছি। কিন্তু এই ঘটনাটা মনে পড়লেই আমি নিজে নিজেই লজ্জিত হই, নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিই, দুঃখিত হই গুরুমহারাজের চরনে ক্ষমা প্রার্থনা করি!! (ক্রমশঃ)
জয় গূরূজী ।জয় ন’কাকা ।