গুরুমহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) – এর ছোটভাই সদ্য পরমানন্দলোকপ্রাপ্ত গৌতমের কথা হচ্ছিল। যেহেতু গৌতমের সাথে আমি প্রায় ৭/৮-বছর একই ঘরে (সাধনা ভবনের দোতলায় ১৭-নং ঘরে) পাশাপাশি কাটিয়েছি ফলে রাত্রে-দিনে, দুজনের মধ্যে বহু কথা হয়েছে। আর হওয়াটাই তো স্বাভাবিক! একে তো গৌতম গুরুমহারাজের সহোদর ছোটভাই আর আমার তখনকার অনুসন্ধিৎসু মন গুরুমহারাজকে কেন্দ্র করেই সতত ক্রিয়াশীল থাকতোতাই এটা আমার কাছে ছিল যেন ভগবান পরমানন্দের দেওয়া gift!! একসাথে থাকতে থাকতে অন্তরঙ্গতা জমতে বেশি দেরি হয় নি অন্তরঙ্গতা হোল গৌতমের স্ত্রী পার্বতীর সাথেও। ফলস্বরূপ শুরু হোল যাওয়া-আসা! আমি কৃষ্ণদেবপুর যেতাম, ওরাও দুজনে আমাদের বাড়িতে(রশুই গ্রামে) প্রায়ই আসতো। সুতরাং আপনারা বুঝতেই পারছেন গৌতমদের বাড়ির অনেক কথা, এমনকি পারিবারিক অনেক গোপন কথাও আমার কাছে সে ব্যক্ত করেছে! সে কথাগুলি সব তো এখানে বলা যাবে না আর তার প্রয়োজন ই বা কি আছে? যেটুকু সবার গ্রহনযোগ্য সেটুকুই বলি! গৌতমের পারিবারিক অন্যান্য ব্যাপারে আমার তেমন অবশ্য বিশেষ interest-ও ছিল না, আমার শুধু জানার একটাই আগ্রহ ছিল ও(গৌতম) ছোটবেলায় দাদাকে (গুরুমহারাজকে) কেমন দেখেছিল, তাঁর কোন বিশেষ রূপ বা বিশেষ কোন ঘটনার কথা মনে আছে কি না এইসবে!! আরো জিজ্ঞাসা করতাম গুরুমহারাজের কথা, মা(জননী নিভারানী) কি কি বলতেন, অন্যান্য দাদা বা দিদিরা কি বলত?
আশ্চর্যজনকভাবে আমার আগ্রাসী জিজ্ঞাসা-ক্ষুধার উত্তর তেমন করে অবশ্য গৌতম কখনোই দিতে পারেনি বা হয়তো দেয় নি। এগুলো নিয়ে পরে আলোচনা হবে এখন পূর্বের জায়গায় ফিরে যাই। একটা কথা আগেই বলে রাখি প্রতিটি মানুষেরই ‘নিজস্বতা’ আছে, তাই এই জগৎ সংসার সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে, যে কোন ঘটনা সম্পর্কে _প্রতিটি মানুষের view বা দৃষ্টিভঙ্গি পৃথক! তাই গৌতম যে সব কথা বলেছিল সেগুলি ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা ঘটনার কথা! যদি বর্তমানের কেউ সেই একই ঘটনাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চান তো তিনি তা করতেই পারেন। আবার কেউ যদি সংশোধন করে দিতে চান, তাহলেও Welcome!!!
আমরা গত এপিসোডে কথা বলছিলাম গৌতমের কামারকুন্ডু তে ডঃ হারাধন মান্নার নার্সিংহোমে চাকরি প্রসঙ্গে। ওখানে গৌতম বেশ সন্মান জনক পদেই চাকরি কোরতো। ওর কাজ ছিল বাইরে থেকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে টাকা আদায় করে নিয়ে আসা! এই করতে গিয়ে একবার ও (গৌতম) ছিনতাইবাজদের হাতেও পড়েছিল! কিন্তু একদিন সামান্য কোন কারণে মনোমালিন্য হওয়ায় গৌতম ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে সোজা চলে আসে দাদা (গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ )-র কাছে!
আমি ব্যক্তিগতভাবে জানতাম যে ডাক্তার মান্না এই ঘটনার পরপরই বারবার গুরু মহারাজের কাছে এসে যাতে গৌতম আবার Join করে তার অনুরোধ করেছিলেন ৷ ডঃ মান্না এটাও বলেছিলেন – চাইলে গৌতম এবং পার্বতী(যেহেতু পার্বতীও গ্রাজুয়েট) দুজনেই ওনার নার্সিংহোমে কাজ করতে পারে । কিন্তু গর্ভধারিনীর কাছে একজন থাকা প্রয়োজন বলেই হোক্ বা অন্য কারণে – গুরু মহারাজ এতে রাজি হননি ৷ সেই থেকে গৌতমকে উনি বনগ্রাম আশ্রমেই থেকে যেতে বলেন এবং প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করতে বলেন ! গুরু মহারাজ সেইসময় তৃষাণ মহারাজকে বলে শিক্ষকতা করার জন্য কিছু পারিশ্রমিকেরও ব্যবস্থা করেছিলেন ৷ তখন বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে হাইস্কুলও চালু হয়ে গিয়েছিল ৷ প্রথমে শুরু হয় প্রাইমারী তারপরে সেকেন্ডারী ৷ তখন (১৯৯৬/৯৭ সালে) বনগ্রাম আশ্রমে আবাসিক ছাত্র সংখ্যা কত আর হবে – এই ধরুন ৭০/৮০ ! ফলে প্রাইমারী সেকসনে হয়তো – ৪০/৫০ জন ! অর্থাৎ শিশুশ্রেণী থেকে ফোর ক্লাস পর্যন্ত এক একটা ক্লাসে ৮/১০ জন করে বালক । তখনও প্রাইমারীতে গ্রাম থেকে ছেলেরা বড় একটা আসতো না – বনগ্রামে যেহেতু সরকারী প্রাইমারী স্কুল রয়েছে তাই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে আসবে কেন ? শুধুমাত্র খুব বেশি যারা আশ্রম-ভক্ত, এমন দু-একটি বাড়ির শিশুরা বনগ্রাম আশ্রমে পড়তে আসতো ! যাইহোক , তখনও উভয় স্কুলেই বাইরের কোন শিক্ষক ছিল না – শিক্ষকরা সবাই ছিল আশ্রমিক । ফলে বেতন দেওয়া কোন টিচার তখনও আশ্রমে ছিল না ৷ সেই অর্থে হয়তো গৌতম-ই বনগ্রাম মিশনের Stipend পাওয়া প্রথম শিক্ষক ! গৌতম যখন Primary School-এ Join করল তখন Primary-র Headmistress ছিল ব্রহ্মচারিনী মালা ৷ মালা দাস (প্রামাণিক) স্বামী স্বরূপানন্দ মহারাজের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় । (মালার বাবা ৺কালীচরণ দাস/ প্রামাণিক ত্রিবেণীতে একটা কোম্পানীতে বেশ উঁচু Post-এ চাকরী করতেন । স্বামী স্বরূপনন্দের সাথে আমি ত্রিবেণীতে ওদের Quarter-এ ‘চরৈবেতি’ পত্রিকার কাজে অনেকবার গেছি । ৺কালীবাবু বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন – খুবই ভালো মানুষ । ব্রহ্মচারিণী মালার মা লক্ষ্মীদি, শান্তশিষ্ট গৃহবধূ ছিলেন ৷) বনগ্রাম আশ্রমে গৌতম টিচার হিসাবে Join করার কিছুদিনের মধ্যেই আমিও হাইস্কুলে Join করি ! হাইস্কুলে তখন সব টিচার-ই ছিলেন আশ্রমিক – খুব সম্ভবত একমাত্র ন’কাকা (৺শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)-ই ছিলেন আশ্রমের বাইরে থেকে আসা প্রথম শিক্ষক । এরপর বাইরে থেকে শিক্ষক হিসাবে আমার আগমন এবং তারপর থেকে পরপর বাইরে থেকে বিভিন্ন Retired Teacher-রা এবং অন্যান্য টিচাররা আশ্রমের হাইস্কুলে শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন ৷ ১৯৯৯-সালের ২৭-শে নভেম্বর গুরুমহারাজের শরীর ছাড়ার পর থেকে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন হাইস্কুল খুবই সমস্যার সন্মুখীন হয়! গুরুমহারাজের আকস্মিক মহাপ্রয়ানে শোকাবহ পরিস্থিতিতে অনেক সাধু, ব্রহ্মচারী – ব্রহ্মচারীনী বনগ্রাম আশ্রম থেকে চলে গিয়ে, স্বাধীনভাবে সাধন-ভজন করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। হাইস্কুলে আশ্রমিক টিচারের অভাবে তখন থেকে বাইরের সুশিক্ষিত ছেলে মেয়েদের টিচার হিসাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। গুরুমহারাজ কিন্তু চেয়েছিলেন আশ্রমের স্কুলে আশ্রমিক শিক্ষকরাই পড়াবে! কিন্তু কালের নিয়ম তো সকলকেই মানতে হয়, এখানেও তাই বাধ্য হয়েই মানতে হচ্ছে!
গৌতমের প্রসঙ্গে আবার ফিরে যাচ্ছি! সেই সময় ব্রহ্মচারীনী মালার সাথে খুবই বন্ধুত্ব ছিল আর এক আশ্রমিক টিচার মন্জুমা-র! কোন কারণে মন্জুমা আশ্রম ছেড়ে চলে যায়। মালা-মা প্রাইমারি সেকসনের head teacher এর পদ ছেড়ে দেওয়ার পর আশ্রম কর্তৃপক্ষ গৌতমকে প্রধান শিক্ষকের পদে বহাল করে। সেই থেকে শরীর ছাড়ার আগে পর্যন্ত গৌতম নিষ্ঠাভরে ঐ দায়িত্ব পালন করে চলেছিল। (ক্রমশঃ)