শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের লেখা *সহজতা ও প্রেম* গ্রন্থ থেকে পঙক্তি তুলে তুলে আমরা এতোদিন আলোচনা করছিলাম। আগের এপিসোডেই আমরা ঐ গ্রন্থের শেষ প্যারাগ্রাফ এবং পরিশিষ্টের দুটি কবিতাও তুলে ধরেছিলাম। এইবার আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থের পঙক্তিগুলি তুলে সকল পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছি। আসলে এই কাজ করার পিছনে কারণটি হোলো – গুরুমহারাজ স্বয়ং একবার সিটিং-এ বলেছিলেন *সহজতা ও প্রেম* বা *বাউলের মর্মকথা*-র মতো বইগুলি একবার-দুবার নয়, বারবার পড়তে হবে, তবে যদি এই বইগুলিতে উল্লিখিত কথার মর্মার্থ কিছুটা হোলেও ধারণা করা যায় ! – এটাই উদ্দেশ্য ! সকল মানুষের তো আর সবসময় গুরুমহারাজের লেখা বইগুলি পাঠ করা সম্ভব হয় না – আর হোলেও গড়গড় করে পড়ে গেলেও মর্মার্থগুলি ঠিক আত্মস্থ হয় না ! কিন্তু এখানে ছোটো ছোটো আকারে একটু একটু করে পাঠ করতে করতে যদি গুরুমহারাজের করা চিরন্তন সত্যের ব্যাখ্যার মর্মকথাগুলি পাঠককুলের মর্মস্থলে প্রবেশ করে – তাহলেই এই প্রচেষ্টার সার্থকতা !
*বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থটিতে কি নিয়ে আলোচনা রয়েছে তার আলোচনায় মুখবন্ধে গ্রন্থটির প্রকাশক স্বামী স্বরূপানন্দ বলেছেন – “এই ছোটো পুস্তকটির মধ্যে ‘বাউল’ শব্দের তাৎপর্য্য, বাউলদের উৎপত্তি, বাউলতত্ত্বের রহস্য তথা মানুষতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, আদিরস বা কামতত্ত্ব, বাউলদের রাগমার্গের সাধনা ও সাধনপদ্ধতির গুহ্য রহস্য, বিশেষ করে প্রেমতত্ত্বের অতি অপূর্ব মনোরম বিশ্লেষণ, তাঁদের বেশভূষার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য, সাধনায় সংগীত ও নারীর অনবদ্য ভূমিকা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।” এছাড়াও স্বরূপানন্দ মহারাজ লিখেছেন – ” অতি দুরূহ গোপন তত্ত্ব, যা ইতিপূর্বে কোনো গ্রন্থে এতো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা তো হয়নি – মানুষের নিকট যা ছিল রহস্যাবৃত, লেখক (স্বামী পরমানন্দ) বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে, সরল ও সাবলীল ভঙ্গীতে, দরদী মন নিয়ে, বোধির দৃষ্টিতে ও প্রাণোচ্ছল ভাষায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন।”
যাইহোক, আমরা এখন চলে যাই গুরুমহারাজের লেখা গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা*-র একেবারে শুরুর কথাগুলিতে, যেখানে গুরুমহারাজ এইভাবে শুরু করেছেন — ” প্রিয় আত্মন্ – বেদ ও উপনিষদের মর্মবাণীর মধ্যে ভারতের শাশ্বত সনাতন ধর্মের ভাবটি বিদ্যমান। এই উপনিষদ-ভিত্তিক ‘ব্রহ্মতত্ত্ব’ বা ‘আত্মতত্ত্ব’-ই হোলো বেদের সার। এই ‘আত্মতত্ত্বে’-র আলোচনা মূলক গ্রন্থই *বেদান্ত*! তাহলে আমরা এটা বুঝতে পারলাম যে, ভারতবর্ষের শাশ্বত সনাতন ধর্মের মূলভাবটি রয়েছে উপনিষদের মর্মবাণীর মধ্যে। বেদের সার হোলো ব্রহ্মতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব, আর বেদান্ত বা উপনিষদে এই আত্মতত্ত্বের-ই আলোচনা রয়েছে।
এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন – ” ঔপনিষদিক ধারা বা বেদান্ত প্রতিপাদ্য ‘আত্মতত্ত্ব’– এই সংস্কৃতির ভাবধারা আজও বহন করে চলেছেন বাউল সন্ন্যাসীরা। বাউল সেই বেদান্ত-উপনিষদ প্রতিপাদ্য আত্মতত্ত্বের অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়েন ঘর ছেড়ে – কোথায় তাঁর সেই ‘মনের মানুষ’ বা দেহাতীত আত্মতত্ত্ব ? (তিনি) উন্মুখ হয়ে ঘুরতে থাকেন দেশ হতে দেশান্তরে ! তাঁর বাউন্ডুলে বিবাগী মন খুঁজতে থাকে সেই নিত্য-শাশ্বত-অবিনশ্বর বেদপুরুষ আত্মতত্ত্বকে। তাঁর বৈরাগ্য-বিধুর বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে অনুরাগে – “কোথায় পাব তাঁরে, আমার মনের মানুষ যে রে !” অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর চির আকাঙ্ক্ষিত সেই ‘মনের মানুষ’-কে।”
কি সাংঘাতিক একটা উচ্চতায় উত্থিত করে দিলেন গুরুমহারাজ বাউল সন্ন্যাসীদেরকে ! কারণ উনি বললেন – বেদান্ত প্রতিপাদ্য “আত্মতত্ত্ব” অনুসন্ধানের ধারা বহন করে বাউল সন্ন্যাসীরা। ঘরছাড়া সর্বত্যাগী এই সন্ন্যাসীরা বাউন্ডুলে হয়ে দেশে-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে “আত্মতত্ত্ব”-ই খুঁজে বেড়ায় এবং একদিন নিজের মধ্যেই সেই আত্মতত্ত্বস্বরূপ “মনের মানুষ”-কে খুঁজে পায়। ‘কোথায় পাবো তারে’– পথে পথে একতারা হাতে গান গেয়ে এই যে অনুসন্ধান, তার পরিসমাপ্তি ঘটে ‘মনের মানুষ’-কে লাভ করে।
এরপরে গুরুমহারাজ বললেন – “এই বিরাট বিশ্বসংসাররূপে যাঁর স্বতঃপ্রকাশ, সেই তত্ত্বই তাঁর (বাউলের) ভিতর প্রকাশ। সীমার ভিতর তিনি বোধেবোধ (বোধ) করেন সীমাহীনকে। অসীমের সীমাধারণ আর সীমার অভিব্যক্তি অসীমের প্রতি। সবই প্রেমময় পরমেশ্বরের লীলা – সবই তাঁর প্রকাশ। বাউল জীবনের ভিতর সেই পরমতত্ত্বকে অপরোক্ষ অনুভব করেন। তিনি দেহভান্ডেই ব্রহ্মাণ্ডের বোধেবোধ (বোধ) করেন।”
বাউলের মূলভাবটি হোলো – “ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব”। বাউল সাধনায় সাধকেরা নিজের দেহভান্ডের তত্ত্বকে জেনে ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্বকে বোধ করতে সমর্থ হ’ন – তাই বলা হয় “ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব”! পরম প্রেমময় পরমেশ্বর যেমন সামগ্র বিশ্ব-সংসাররূপে প্রকাশিত, তেমনি তিনিই (সেই পরমেশ্বর) মনুষ্যসহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবরূপেও প্রকাশিত। কিন্তু মানুষ যেহেতু এই পৃথিবীগ্রহের সর্বােন্নত জীব, তাই তার মধ্যেই পরমাত্মাস্বরূপ ব্রহ্মের অধিক প্রকাশ এবং একমাত্র মানুষই সেই বোধে উপনীত হোতে পারে যে “অহং ব্রহ্মাস্মি”! এই বোধই “আত্মতত্ত্ব”– যার সন্ধানে ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে একতারা হাতে আলখাল্লা পড়ে বেড়িয়ে পরে উদাস বাউল ! কন্ঠের গানে ভেসে আসে চিরন্তনী সুর – ” আমি কোথায় পাবো তারে – আমার মনের মানুষ যে রে !”