শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরামানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন থেকে গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা* থেকে লাইন তুলে তুলে ধরবো – যাতে যুগপুরুষ, যুগাবতার স্বামী পরমানন্দের দ্বারা যুগপ্রয়োজনে কথিত (লিখিত) কথাগুলি বা শিক্ষাগুলি আমাদের সকল পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় এবং আমরা সবাই তাঁর ঐ সকল শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের জীবনে যোজনা করতে পারি।
আমরা এখন বাউলের মর্মকথার পরবর্তী পাঠ গ্রহণ করি। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” জীবন পরমেশ্বরেরই প্রকাশ। তাঁরই জীবনরূপী লীলা চলছে। সেই এক তত্ত্বই বহু নাম-রূপ ধারণ করে লীলা করছেন। এই লীলার আধার –‘আনন্দ’, আর আনন্দের আধার –‘প্রেম’। এই বিশ্বাসংসার তাঁর প্রেমময় প্রকাশ। এই অনন্ত প্রেমতত্ত্বে তাঁর আনন্দময় লীলা চলছে। সমস্ত কিছুর ভিতরেই তিনি বিরাজমান বা সমস্ত কিছুতেই ভাসমান। এক কথায় তিনি সবেতে, সব তাঁতে – তিনি ছাড়া কিছু নাই। (তিনি) ওতপ্রোত অখন্ড। তিনি নিত্য-শাশ্বত-সনাতন। তিনিই আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের এই কথাগুলি অনেকটাই যেন ওনার লেখা প্রথম গ্রন্থ *সহজতা ও প্রেম* গ্রন্থেরই Continuation মনে হোচ্ছে__ না ? গুরুমহারাজ এখানেও সেই ‘জীবনে’রই জয়গান গেয়েছেন – কারণ এই জীবন পরমেশ্বরেরই প্রকাশ। সেই পরমেশ্বর সব হয়েছেন। তিনি অনুতে অনুস্যূত, আবার বিভুতে ওতপ্রোত। গুরুমহারাজ আত্মতত্ত্বই যে ব্রহ্মতত্ত্ব তাও বলেছেন। যাইহোক, সেই নিত্য-শাশ্বত-সনাতন পরমেশ্বর সম্বন্ধে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন ?
উনি এরপর বললেন – ” অজ্ঞানই শুধু অনিত্য ! অবিদ্যা-আচ্ছন্ন জীব তা উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ যে অসহজ, আবিদ্যাগ্রস্থ – সে মনের মানুষকে ভুলেছে। সেইজন্য তার এতো দুঃখ-কষ্ট, শোক ও হাহাকার। ‘মনের মানুষ’-কে না জেনে তার জীবন বিষময় হয়ে পড়েছে। অসহজ ও কপট ভাবের হেতু সে যে অমৃতস্বরূপ – এটা তার বোধ নাই। তাই শোকার্ত হয়ে বিষময় জীবন-যাপন করছে। আত্মবিস্মৃত, আত্মজ্ঞানরহিত, অবিদ্যাগ্রস্থ, অজ্ঞান জীবই অসহজ। সেইজন্যই সে শোক করছে। আর আত্মসচেতন, অবিদ্যা-অজ্ঞানমুক্ত আত্মতত্ত্ববিদ্ ব্রহ্মজ্ঞই আত্মস্বরূপ, আত্মজ্ঞ বা সহজ।
উপনিষদের এই মর্মবাণীকে আপনার জীবনে বোধে বোধ কোরে, সেই বোধকে সহজ ভাষায় গান রচনা করে গেয়ে বেড়ান বাউল – গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে, মানুষের দ্বারে দ্বারে। এঁরা সাক্ষাৎ জীবনের পূজারী – অভিনয়ের পূজারী নন।”– এইবারে এবং এতক্ষণে আমরা বেশ বুঝতে পারলাম যে, ‘বাউল’ যেহেতু জীবনের পূজারী, তাই বাউলরাজ গুরুমহারাজ তো ‘জীবন’-কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেবেনই বা তিনিও পরিপূর্ণভাবে জীবনের পূজারী হবেন-ই ! গুরুজী বললেন ‘অসহজ’ ও কপট ভাবের হেতুই – জীব যে স্বয়ং অমৃতস্বরূপ এই বোধ হারিয়েছে – এটাই আত্মবিস্মৃতি, যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ঘটেছে। আর ‘সহজ’ মানুষ তাঁরাই – যাঁরা অবিদ্যা ও অজ্ঞানমুক্ত আত্মতত্ত্ববিদ্ ব্রহ্মজ্ঞ ! এঁরাই প্রকৃত জীবনের পূজারী – আর আমরা সাধারণ মানুষেরা অভিনয়ের পূজারী। আমাদের মধ্যে পরস্পরের স্নেহ-প্রেম-শ্রদ্ধা-ভালবাসা ইত্যাদির যে সম্পর্ক, যে জগৎ – তার সবটাই অভিনয়, কোনটাই সত্য নয়।
যাইহোক, এরপরে গুরুমহারাজ ‘বাউল’ প্রসঙ্গে বলেছেন – ” ‘বাউল’ কোনো সম্প্রদায় নয় বা বাদ-গ্রস্থ দলও নয়। বাউল বোধির দ্বারা অভিভূত পরম আত্মতত্ত্বকে সহজ ভাষায় প্রচার করেন। বাউলের প্রচারিত জীবনবাদ – ধর্ম। জীবনকে বাদ দিয়ে ধর্ম নয়। জীবনের ভিতর দিয়েই তাঁকে অপরোক্ষ অনুভব করতে হবে, জীবনকে নষ্ট করে নয়। জীবন সেই তত্ত্বের প্রকাশ। জীবনের ভিতর দিয়ে সেই তত্ত্বের সাক্ষাৎকার – এটাই জীবনের রহস্য। এই রহস্য উদঘাটন করে মানবকে সেই পরমতত্ত্ব বা অমৃতস্বরূপ আত্মতত্ত্বকে ‘বোধে বোধ’ করতে হবে – জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সেটাই। এইজন্যেই ‘বাউল’ উপনিষদের সৃজনমুখী আত্মতত্ত্বের সাধক ও প্রচারক।”
*বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থটিতে গুরুমহারাজ ‘বাউল’ প্রসঙ্গেই কথা বলেছেন। প্রকৃত বাউল কি, বাউলের উৎস, এর জীবনযাত্রা বা জীবনধারা, বাউল পথের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকে উনি আধুনিক দৃষ্টিতে যুগোপযোগী করে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষজনের ‘বাউল’ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণাই শুধু দূর করেন নি – ‘প্রকৃত বাউলে’র সঠিক সংজ্ঞা উপস্থাপন করায় – উনি ‘বাউল’দের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সহস্র-সশস্ত্রগুণে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। গুরুমহারাজ ‘বাউল’ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই একটা সাংঘাতিক কথা বলেছেন – ” ‘বাউল’ কোনো সম্প্রদায় নয় বা বাদ-গ্রস্থ দলও নয়।” ‘বাউল’ বাদগ্রস্থ নয়, মানেই হোচ্ছে বাউলেরা কোনো বিবাদের মধ্যে নাই, আর এরা কোনো সম্প্রদায় নয় – অর্থাৎ বাউলদের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি নাই।
প্রকৃতপক্ষে ‘বাউল’ মানেই হোলো ‘বোধিব্যক্তি’, তাই তো তারা আত্মতত্ত্বকে বোধ করে – সহজ ভাষায় এই তত্ত্বকে প্রচার করে থাকে কথা বা বাণীর মধ্যে দিয়ে, সংগীতের মধ্যে দিয়ে। বাউল-ই বোধ করে যে জীবন হোলো পরমেশ্বরের প্রকাশ বা সেই পরমতত্ত্বের প্রকাশ। আর এই জীবনকে কাজে লাগিয়েই (সাধনার দ্বারা) মানব জীবনের যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অমৃতস্বরূপ পরমতত্ত্ব – তা লাভ করতে হবে, তা ‘বোধে বোধ’ করতে হবে।৷