শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা থেকে লাইন তুলে তুলে এখানে সকল পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টায় ছিলাম৷ আগের আলোচনার পর এবার আমরা দেখবো গুরুজী ‘বাউল’ প্রসঙ্গে আরো কি কি কথা বলেছেন। উনি বলেছেন – ” সাধনার রহস্য হোলো আত্মস্বরূপ-(এর) বা আত্মবোধে-(র) বোধ হওয়া ! জীবন তখন কামগন্ধহীন প্রেমস্বরূপে পরিণত হয়। এই দিব্যপ্রেম-ই আত্মার প্রকাশ বা ঈশ্বরের মাধুরী। পরমেশ্বরের প্রকাশ এই প্রেম ‘বোধ’ করাই হোলো মানব জীবনের চরম ও পরম উদ্দেশ্য।”
গুরুমহারাজ এখানে বাউলদের সাধনরহস্য সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলেছেন। সকল ধর্মমতের সাধকদের সাধনার চরম ও পরম লক্ষ্যই হোলো – ‘আত্মবোধ’। সর্বোপরি একবার প্রেমবোধ বা আত্মবোধ হয়ে গেলেই মানবের জীবন কামগন্ধহীন হয়ে যায় এবং ঐ জীবনেই প্রকৃত প্রেমের প্রকাশ ঘটে। এই দিব্যপ্রেমকে গুরুমহারাজ বলেছেন – “এটি আত্মার প্রকাশ” এবং বলেছেন – “এটি ঈশ্বরের মাধুরী”।এরপর গুরুমহারাজ বলেছেন যে, ” বাউলের ‘মনের মানুষ’ – তাঁর ‘ভালোবাসার ভগবান’ সকলের ভিতরেই বিরাজমান। মানবের দেবতা মানবের মধ্যেই। মানুষ যখন বাইরে খুঁজতে যায় ‘আপনা’-কে, তখনই সে আপনাকে পর করে দেয়। আপনাকে মানুষ কামনা-বাসনায়-ভোগের উপকরণে খুঁজতে যায়। আর বাইরের উপকরণে নিজেকে খুঁজতে যায় বলে মানবের এতো দুর্দশা ভোগ !” মহাবাউল গুরুমহারাজ এইবার বাউল সাধনার মূল রহস্য সম্বন্ধে আমাদের অবগত করেছেন। কি সুন্দর ‘আত্মতত্ত্বে’র শিক্ষা দিলেন উনি ! ‘মানবের দেবতা’ মানবের মধ্যেই রয়েছে। এটিই বাউলের ‘মনের মানুষ’, তাঁর ‘ভালোবাসার ভগবান’। সাধারণ মানুষের যে এতো দুর্দশা তার কারণ হিসাবে গুরুমহারাজ একটা অপূর্ব কথা বলেছেন – ” মানুষ ‘আপনাকে’ বাইরে খুঁজতে চায়, কামনা-বাসনা-ভোগের উপকরণে খুঁজতে চায় – এরফলেই মানুষ ‘আপনাকে’__ ‘পর’ করে দেয়।
এরপরে গুরুমহারাজ এই আত্মতত্ত্ব বোধের ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বললেন এবং কেন আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের এই বোধ হোচ্ছে না – তাও বললেন ! উনি বললেন – “সেইজন্য মানব (যেন) অপরের চোখে নিজেকে দেখেছে। অপরের ধার করা চোখে নিজেকে দেখছে। নিজের চোখ রয়েছে, তথাপি আপনার চোখে সে কিছুই দেখছে না। বাইরে তাকে খুঁজবে কিন্তু নিজের ভিতরে খুঁজবে না, সেইহেতু আবিষ্কারও হয় না। আর এইজন্যেই বিবাদ, মতবাদ, শোক ও দুঃখ-কষ্ট এবং বিক্ষিপ্ত আপনহারা মানব। মানবের দুর্গতি আপনাকে ভুলে বা আত্মবিস্মৃতি হয়ে।৷ আত্মবোধ হারিয়ে অন্তঃকরণে বিকার উপস্থিত হোলে আর ‘মনের মানুষে’র অপরোক্ষ অনুভব হয় না। এটাই আত্মবিস্মৃতি বা অসহজতা।”
বাইরের উপকরণে ‘নিজে’কে খুঁজতে চাওয়া অথবা ভোগ-ঐশ্বর্য-কামনা-বাসনার মধ্যে ‘নিজে’কে খুঁজতে চাওয়া-কেই গুরুমহারাজ বলেছেন “অপরের দৃষ্টিতে নিজেকে দেখা” বা “অপরের ধার করা চোখে নিজেকে দেখা”। এইভাবেই আমরা সাধারণ মানুষেরা শিক্ষিত-অশিক্ষিত-ধনী-নির্ধন-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সকলেই বহির্জগতের রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের জগতে এমনভাবে মত্ত হয়ে রয়েছি যে, নিজ নিজ অভ্যন্তরে তার দৃষ্টি দেওয়া হয়ে ওঠে না। আর তা হয় না বলেই – “আমিই আত্মস্বরূপ” বা “আমিই ব্রহ্ম”– এই আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্বের বোধ হয় না – প্রকৃত “আমি”-র আবিষ্কার হয় না, ‘আমি’-ই আত্মস্বরূপ এই বোধ হয়ে গেলেই সমগ্র বিশ্বে আর কেউ ‘অপর’ বা ‘পর’ এই বোধ কাজ করে না – তখনই ঠিক ঠিক প্রেমবোধ জন্মে, সকলকেই আপন বোধ হয়, ‘পর’-বোধ কাজ করে না। ফলে সমস্ত প্রকারে মতবাদ, বিবাদ-বিসম্বাদ-দুঃখ-কষ্টের অবসান হয়। মানব মনের বিক্ষিপ্ততা থাকে না – মন শান্ত হয়, মানব শান্তি পায়। কারণ আত্মবোধের অভাব-ই মানবের আত্মবিস্মৃতির কারণ, যা মানবের অন্তঃকরণকে বিকৃত করে তোলে। আর এরফলেই মানব অসহজ হয়ে ওঠে।
আগের প্রসঙ্গ থাক্, এখন আমরা এইবার দেখবো গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে আরো কি বলেছেন। উনি বলেছেন – ” মানব নিজেকে প্রতিষ্ঠায় বা খ্যাতিতে দেখছে, ভোগের সামগ্রীতে দেখছে – কিন্তু নিজেকে নিজের ভিতর দেখছে না। সুতরাং ‘মনের মানুষ’-কে বা আত্মতত্ত্বকে নিজের ভিতরেই আবিষ্কার করতে হবে। যা নিজের ভিতরে, বাইরে ন’ন। তুমি সেই অমৃততত্ত্ব বা আত্মতত্ত্ব। তুমি অমৃতের – অমৃত তোমার। তুমি অমৃতস্বরূপ। “সবার উপরে মানুষ সত্য”। তুমি অমৃতের পুত্র। তত্ত্বমসি।৷”
এতোক্ষণে গুরুমহারাজ ঔপনিষদিক আত্মতত্ত্বের সার কথাগুলি বললেন। মহাজনগণ গানে গানে বহুপূর্বেই সেই একই কথা বলে গেছেন – “ডুব-ডুব-ডুব রূপসাগরে আমার মন, তলাতল-পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্নধন।” শাক্তসাধক বলেছেন – “ডুব দে রে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।” সুতরাং দেখাই যাচ্ছে ‘বাউল’ সবার কথা কয় – সবার কথা লয়। সকল মতবাদের ঊর্ধ্বে উঠে বাউল সকল মতের সমন্বয় সাধন করে। কারণ বাউল নিত্য-শাশ্বত-চিরন্তন-সত্য অর্থাৎ ঋষিদের উপলব্ধ উপনিষদ প্রতিপাদ্য নিত্য সত্যের কথাই বলে। সকল ধর্মমতেরই একমাত্র উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হোলো আত্মবোধ বা ঈশ্বরলাভ বা পরম প্রেমলাভ। সেই লক্ষ্য পূরণ হওয়া ছাড়া বাকি যা কিছু – সে সবই নিছক আচার-অনুষ্ঠান-উৎসব ছাড়া আর কিছুই নয়। যা চরম অজ্ঞানতাপ্রসূত কিছু মানবতাবিরোধী সংস্কারের জন্ম দেয়। আর তাই নিয়েই চলে মানুষে মানুষে বিরোধ-হিংসা-মারামারি-রক্তপাত !!