শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ওনার লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা থেকে লাইন তুলে তুলে এই আলোচনা আগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলাম। এখন দেখা যাক পরবর্তী অংশে সহজিয়া বৈষ্ণব ও সহজিয়া বাউলদের প্রসঙ্গে গুরুমহারাজ আরও কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – “বৈদিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত যে সমস্ত বৈষ্ণব মতবাদগুলি প্রচলিত আছে – যথাক্রমে গৌড়ীয়, বল্লভ, নিম্বার্ক, শ্রী এবং মধ্ব – এই মতবাদগুলির সঙ্গে সহজিয়া বাউলদের মতের পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সহজিয়া বাউলগণ বলে থাকেন – ‘ যা বৈদিক সম্প্রদায়ের অনুগত সাধনা, তা হোলো সাম্প্রদায়িক সাধনা।’ রসিকগণ (প্রকৃত বাউল) বলেন বেদাদি শাস্ত্রে কেবল রসতত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যথা – ‘ রসো বৈ সঃ। রসং হ্যেবায়ং লবধ্বানন্দী ভবতি। কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণাৎ, যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ, এষ হ্যেবানন্দয়াতি।’-[(তৈত্তিরীয়ােপনিষদ্ ২/৭), অর্থঃ– তিনিই (ব্রহ্ম) রসস্বরূপ। জীব সেই রসকে লাভ করেই আনন্দিত হয়। হৃদয়-গুহাতে যদি অপরোক্ষ আনন্দ না থাকতো, তবে কেই বা অপানক্রিয়া করতো, কেই বা প্রাণক্রিয়া করতো(অর্থাৎ বেঁচে থাকতো) ?]
কিন্তু রসতত্ত্বের সাধনা বেদে স্পষ্টতঃ উল্লিখিত বা নির্দিষ্ট নাই। এই রসতত্ত্ব হলো অতি গুহ্য বিষয়। কেবলমাত্র ভগবৎকৃপা এবং গুরু-কৃপাবলে এটা অবগত হওয়া যায়। এই রস-সাধনারই নামান্তর – বাউলদের ‘সহজ সাধনা’।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! আমরা একটা সাংঘাতিক তত্ত্বের মুখোমুখি হয়েছি, কারণ আমরা সাধারণভাবে এতকাল ধরে জানতাম যে, ভারতবর্ষে প্রচলিত সাধন-পদ্ধতির সবই বোধয় বেদ-উপনিষদে উল্লেখ রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মমত এবং কিছু লোকায়ত ধর্মমত রয়েছে যা বেদ বহির্ভূত – এটাও জানতাম, কিন্তু সহজিয়া বাউলদের সাধনা বা সাধন-পদ্ধতিও যে ঐ দলেই পড়ে যাবে – তা সত্যি সত্যিই জানতাম না ! এইসব সাধনতত্ত্ব বাউল-মহাজনদের জীবন থেকে পাওয়া, পরম্পরাগতভাবে পাওয়া। বাউলগণ ভগবৎকৃপার সাথে সাথে গুরুকৃপাকেও খুবই মর্যাদা দিয়ে থাকেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, সাধকের উপর গুরুকৃপা থাকলেই রসতত্ত্বের বোধ হওয়া সম্ভবপর হয়।
এরপর আমরা দেখব সহজিয়া বাউলগণ আরো কি কি বলে থাকেন ! গুরুজী বলেছেন – ” সহজিয়া বাউলগণ বলেন – এই সাধনা সাধারণ মানবের পক্ষে উপযোগী নয়। সদ্গুরুর পরামর্শে এবং তাঁর নির্দেশিত পথে যোগের অভ্যাস দ্বারা পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়জয় সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রস-সাধনায় অধিকার লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়বিজয়ী রসিকগণেরই কেবলমাত্র রস-সাধনায় অধিকার জন্মে।”
তাহলে পাঠককুল ! আমরা এটা বুঝতে পারছি যে, বাউলগণের সহজ-সাধনা আমাদের সকলের পক্ষে করা অসম্ভব। কারণ ইন্দ্রিয়জয় সিদ্ধ হোতে হবে তো – ‘ইন্দ্রিয় বিজয়ী রসিক’ ছাড়া এই সাধনে প্রবেশাধিকার নাই। সুতরাং এই ‘সাধন’ সাধারণ মানবের পক্ষে উপযোগী নয়। সেই অর্থে ‘প্রকৃত বাউল’ যদি কোথাও আপনারা দেখতে পান, তাহলে এটা স্থির নিশ্চিত হবেন যে, তিনি অতি সাধারণ মানব নন, তিনি অবশ্যই অনন্যসাধারণ ! আমরা কিছু কিছু সাধক ‘বাউল’-দের কথাও পাই, যাঁরা সাধারণ মানুষ অপেক্ষা অনেক উন্নত মানব ছিলেন_ এঁদের মধ্যে ভবাপাগলা, লালন ফকির প্রমুখদের নাম উল্লেখযোগ্য ! এই সহজিয়া বাউলগণ ভক্তি ও প্রেমতত্ত্বকে যতটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, অন্যত্র প্রেমভক্তির ঠিক ততটা বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া যায় না। প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! বৈদিক বৈষ্ণব পরম্পরার সাধকেরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত অর্থাৎ সেই অর্থে তারা সাম্প্রদায়িক ! কিন্তু সহজিয়া বাউলগণ ঐসব দলে পড়েন না – কারণ সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবমতগুলির সাধকেরা বেদাদি শাস্ত্রে রসতত্ত্ব বা সহজ-সাধনার পদ্ধতির কথা লেখা নাই বলে তারা এই সাধন practice করে না। কিন্তু বাউলগণ রসতত্ত্বের সাধনা – সহজতত্ত্বের সাধনা করেন, তাঁরা বৈদিক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মত অনুযায়ী চলেন না – তাই তাঁরা অসাম্প্রদায়িক। তাছাড়াও এটা বলা যায় যে, প্রকৃত অর্থেই তাঁরা কোনোই সম্প্রদায়ভুক্ত ন’ন। সেইজন্যেই তাঁদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রীষ্টান ইত্যাদির ভেদ ক্রিয়াশীল নয়। আবার উচ্চবর্ণের জাতি-নিম্নবর্ণের জাতি ইত্যাদিরও ভেদ থাকে না – এইসব অর্থেও বাউলগণকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলা চলে। এছাড়া গুরুমহারাজ_ যে ব্যাপারটার উপর অধিক জোড় দিলেন তা হোলো– ‘সহজিয়া বাউলগণ ভক্তি ও প্রেমতত্ত্বকে যতোটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, অন্যত্র (অন্য যে কোনো সাধনপদ্ধতিতে) প্রেমভক্তির ঠিক ততটা বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না।’ উপরোক্ত কথাগুলির – আরো পরিষ্কার ব্যাখ্যা আমরা নিশ্চয়ই গুরুমহারাজের পরবর্তী আলোচনায় পাবো। আমরা থাকলাম সেই অপেক্ষায়।