শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের মোটামুটি শেষ ভাগে। গুরুমহারাজ বাউলতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে করতে ‘প্রাকৃত তত্ত্ব’ থেকে কিভাবে সহজ-সাধনার মধ্যে দিয়ে ‘অপ্রাকৃত’ তত্ত্বে পৌঁছানো যায় – সেইগুলি আমাদেরকে বোঝাচ্ছিলেন। সুতরাং আমরা বাউল তত্ত্ব বোঝার চেষ্টায়–পুনরায় চলে যাবো ঐ কথাগুলির পরবর্তী অংশে। দ্যাখা যাক্ – সেখানে গুরুমহারাজ এরপরে আরো কি কি বলেছেন।
এরপরে উনি বলেছেন – ” বাউলমতে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব হোলো ‘কামতত্ত্ব’ বা ‘রসতত্ত্ব’ এবং শ্রীরাধাতত্ত্ব হোলো ‘মদনতত্ত্ব’ বা ‘রতিরহস্য’। ঐ রস ও রতির একীভূত অবস্থায় মহাউল্লাস বা লীলামাধুর্য (এরপরে গুরুমহারাজ এই সম্বন্ধে পরে আরো আলোচনা করবেন – এই কথা বলেছেন!)।” প্রিয় পাঠকবৃন্দ – দেখেছেন তো, এইবার গুরুমহারাজ বাউলমতের গুঢ়তত্ত্বের গভীরে আমাদেরকে প্রবেশ করাচ্ছেন। শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব হোলো ‘কামতত্ত্ব’ বা ‘রসতত্ত্ব’ আর শ্রীরাধাতত্ত্ব হোলো ‘মদনতত্ত্ব’ বা ‘রতিতত্ত্ব’ এবং রস-রতির একীভূত অবস্থায় লীলামাধুর্য – এই যে কথাগুলি, এগুলি হজম করা আমাদের মতো সাধন-ভজনহীন সাধারণ স্বল্পবুদ্ধির মানুষের পক্ষে সত্যিই অসম্ভবপ্রায় ! এইজন্যেই গুরুমহারাজ প্রথমেই বলে নিয়েছেন – “সাধনার দ্বারা সিদ্ধ না হোলে, বাউল-রহস্য বোঝা যায় না।” তবুও ওনার কথাগুলি আমরা যদি কিঞ্চিৎ ধারণাও করতে পারি – তাই এই প্রচেষ্টা !
এরপরে আমরা আবার চলে যাবো গুরুমহারাজের কথায় ! উনি এবার বলেছেন – ” বাউলগণ বলেন – মহাভাব অবস্থায় ঐ রস-রতি বিলাসরূপ অনাবিল উজ্জ্বল রসের বোধ (বোধে বোধ) হয়। আর এটাই হোলো শ্রীরাধাকৃষ্ণের মহাউল্লাসময় শৃঙ্গারলীলা। তাঁরা আরও বলেন – যে ‘ভাবে’ শ্রীকৃষ্ণের শৃঙ্গার লীলামাধুর্যের পূর্ণ অনুভূতি হয় – তাই ‘মধুরভাব’, আর মধুরভাবের চরম পরিণতি হোলো মহাভাব ।
প্রিয় পাঠক ! একটা কথা আপনারা সকলেই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, গুরুমহারাজ বারবার ‘বাউলগণ বলেন’ বা ‘বাউলমতে রয়েছে’– ইত্যাদি কথাগুলি ব্যবহার করেছেন। এইসব কথায় দ্বারা উনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, ঐ কথাগুলি গুরুমহারাজের নিজস্ব কথা নয় – বাউল মহাজনগণ যেসব কথা লিখে রেখেছেন বা পরম্পরাক্রমে যেসব শিক্ষা বাউলদের মধ্যে চলে আসছে – উনি সেইসব কথাই বলেছেন, এগুলি ওনার নিজের মৌলিক কথা নয়। তবু গুরুমহারাজ যেহেতু ঐ কথাগুলি ব্যবহার করেছেন – তাই আমরা ধরে নেবো যে, ঐ কথাগুলিই ধ্রুব সত্য কথা ! যাই হোক, আমরা এরপরে দেখবো যে, গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে আরো কি কি বলেছেন !
এরপর উনি বলেছেন – ” বাউলমতে প্রাকৃত প্রেমিক-প্রেমিকা, পরস্পর পরস্পরে শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার ভাব আরোপ করে থাকেন, কারণ স্বরূপে তাঁরা শ্রীরাধা-কৃষ্ণ। সাধনায় সিদ্ধ হোলে বোধের পূর্ণতায় তাঁরা উভয়ে কৃষ্ণত্ব এবং রাধাত্ব প্রাপ্ত হবেন – অর্থাৎ রূপের ভিতর দিয়ে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হবেন – আপন স্বরূপেই তাঁরা পরম আনন্দ আস্বাদন করবেন। আর এটাই হোলো সহজপুরে স্থিতি। এই অবস্থায় রূপ এবং স্বরূপ এক হয়ে যায়। প্রাকৃত নায়ক-নায়িকা অপ্রাকৃত নায়ক-নায়িকা শ্রীরাধাকৃষ্ণ স্বরূপে তদাত্ম্য অর্থাৎ একীভূত লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করেন।”
এই দেখেছেন তো – বাউলমত বা বাউলতত্ত্বের প্রকৃত রহস্যটি কি ? বাউল সাধক-সাধিকারা তাদের সাধনকালে নিজেরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার ভাব আরোপ করেন। কারণ তাঁরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন যে, প্রতিটি নর-ই স্বরূপতঃ শ্রীকৃষ্ণ এবং প্রতিটি নারী-ই স্বরূপে শ্রীরাধা। আর সাধনার অন্তে সামান্য নর-নারীই স্বরূপ প্রাপ্ত হবে অর্থাৎ কৃষ্ণত্ব বা রাধাত্ব প্রাপ্ত হবে। সেইজন্যেই তাঁরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার ভাব আরোপ করে সাধনপথে অগ্রসর হ’ন।
সাধক-সাধিকার স্বরূপ প্রাপ্ত হওয়াটা যেন রূপের ভিতর দিয়ে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আর এই অবস্থায় রূপ এবং স্বরূপ এক হয়ে যায় এবং তাঁরা একীভূত হয়ে পরম আনন্দ বা লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করে থাকেন।
গুরুমহারাজের কথা অনুযায়ী সামান্য নর-নারী (বাউলমতের সাধকেরা) বা প্রাকৃত নায়ক-নায়িকাই সাধনার শেষে অপ্রাকৃত নায়ক-নায়িকা বা শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার সাথে তদাত্ম্য হয়ে যান।… কিন্তু এই কথাগুলি ধারণায় আনা খুবই কষ্টকর। যদিও আমরা দেখেছি_ উপনিষদ এই একই কথা একটু অন্যভাবে বলেছেন। উপনিষদে বলা হয়েছে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘তৎ-ত্বমসি’, ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’– ইত্যাদি। এই কথাগুলির সঙ্গে বাউলমতের প্রাকৃত নর স্বরূপে অপ্রাকৃত শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বে এবং প্রাকৃত নারী_ স্বরূপে অপ্রাকৃত রাধাতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া – একই তত্ত্ব।। এইজন্যেই গুরুমহারাজ বারবার বলে গেছেন – পৃথিবীতে সহস্র সহস্র ‘মত’ রয়েছে, কিন্তু সকল ‘মতে’-র অন্তে পৌঁছালে যে ‘পথ’ পাওয়া যায় সেটিই রাজপথ । আর সেই ‘রাজপথ’ ধরে গেলে তবেই রাজপ্রাসাদে যাওয়া যায়। সেখানে পৌঁছালে তবেই ‘রাজদর্শন'(অর্থাৎ ঈশ্বর দর্শন) হয়। এটাই রূপ এবং স্বরূপের একতত্ত্ব।৷