শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা থেকে বাউল মত অনুযায়ী দেহতত্ত্ব বিষয়ক কথাগুলি এখানে তুলে ধরা হচ্ছিলো। আমরা আগের আলোচনায় দেখেছিলাম – বাউল মতে মানবশরীরকে চার ভাগে ভাগ করেছেন — অক্ষয় সরোবর, প্রেম সরোবর, মানস সরোবর এবং কাম সরোবর। এই চারটি সাগরের সংযোগ রক্ষা করে তিনটি ধারা, যেগুলি হল যথাক্রমে বিরজা (যমুনা), রেবা ও নর্মদা। অক্ষয় সরোবর বা সহস্রার থেকে নিম্নমুখী শক্তির ধারা যথাক্রমে প্রেম সরোবরে (বিরজা পথে), ওখান থেকে মানস সরোবরে (রেবা পথে) এবং শেষে কাম সরোবরে (নর্মদা পথে) পতিত হয় – এর ফলে শক্তিহীন হোতে থাকে মানুষ এবং তার জীবনের যে চরম ও পরমলক্ষ্য নিত্যের মানুষ বা সহজ মানুষের সাক্ষাৎকার – তা লাভ হয় না। কিন্তু ঐ শক্তির ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারলেই নিত্যের মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
আমরা এরপরে দেখবো গুরুমহারাজ দেহতত্ত্ব বিষয়ে বাউলগণের মতাদর্শ অনুযায়ী আরো কি কি বলেছেন। উনি এরপরে বলেছেন – ” সহস্রার চক্রে বা ‘অক্ষয় সরোবরে’ সহস্রদল (মতান্তরে শতদল) কমল শোভিত আছে, আজ্ঞাচক্রে ‘প্রেম সরোবরে’ দ্বিদল কমল বা পারিজাত শোভিত আছে, অনাহত চক্রে ‘মানস সরোবরে’ দ্বাদশদল কমল শোভা পাচ্ছে এবং স্বাধিষ্ঠান চক্রে ‘কাম সরোবরে’ ষড়দল (মতান্তরে অষ্টদল) কমল শোভিত আছে। সহজিয়া বাউলগণ বা রসিকগণই কেবলমাত্র এইসব বোধ করে থাকেন। প্রিয় আত্মন্, সহজিয়া বাউলগণ এইভাবে মানবশরীরের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে থাকেন৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ ‘দেহতত্ত্বে’-র এই যে অংশটি আমরা পেলাম – এটি ভারতীয় শাস্ত্রের যে যোগদর্শন রয়েছে, সেখানেও মানবশরীর অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন চক্রের (মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা ও সহস্রার) এবং ঐ সব চক্রে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন দলবিশিষ্ট কমল বা পদ্মের অবস্থিতির কথা উল্লেখ রয়েছে। সেখানে আমরা পাই যে, মূলাধারে অবস্থিত সুপ্ত সর্পাকৃতি মহাশক্তি কুলকুণ্ডলীনী নিদ্রিত রয়েছে – যোগসাধনার দ্বারা সেই মহাশক্তিকে জাগ্রত কোরে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারলে সেটি একে একে মানবশরীরের বিভিন্ন এন্ডোক্রিন গ্রন্থিসমূহ যেখানে যেখানে অবস্থিত_ ঠিক সেখানে সেখানেই সূক্ষ্মরূপে থাকা ওই চক্রসমূহকে একে একে জাগ্রত করতে থাকে এবং সেখানেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে অবস্থিত বিভিন্ন দলবিশিষ্ট এক একটি কমল বা পদ্ম ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ব্যাপারগুলি মোটেই বাহ্যভাবে পরিদৃশ্যমান নয় – এগুলি সাধকের অন্তর্জগতের ব্যাপার এবং পুরোটাই সাধনসাধ্য বিষয়, আত্মঅনুভব–আত্মউপলব্ধি–আত্মবোধের বিষয়।
কিন্তু বাউলগণ যোগশাস্ত্রের ঐ সাতটি চক্র নিয়ে মাথা ঘামান না – ওনাদের সাধনা মাত্র চারটি চক্র নিয়ে, সেগুলি হোলো :– সহস্রার বা অক্ষয় সরোবর, আজ্ঞাচক্র বা প্রেম সরোবর, অনাহতচক্র বা মানস সরোবর এবং স্বাধিষ্ঠান চক্র বা কাম সরোবর। আর এখানে একটা কথার উপর বারবার জোর দেওয়া হয়েছে যে বাউল(সাধক)গণ বা রসিকজনেরাই এই তত্ত্বের বোধ করতে পারেন – বাকিরা নয়।
যাই হোক, এবার আমরা আবার চলে যাবো গুরুমহারাজের কথায়। দ্যাখা যাক তারপরে উনি কি বলেছেন। এরপরে উনি বলেছেন – ” সহজিয়া বাউলগণ বলেন যে, সহজ সাধনা বা রসতত্ত্বের বেদে কোনো স্পষ্টতর উল্লেখ নাই। কিন্তু তন্ত্র আদি কিছু আগম শাস্ত্রে এর বিশেষ উল্লেখ আছে। সুতরাং এটা অতি গুহ্য বিষয়, রসিক ভিন্ন রসতত্ত্বের মহত্ব বোঝা অতি দূরহ।” প্রিয় পাঠক, গুরুমহারাজ আরো একবার উল্লেখ করলেন যে বাউলতত্ত্বের সাধনা বা সহজ সাধন অথবা রসতত্ত্ব -এর কথা বেদে উল্লেখ নাই অর্থাৎ নিগম শাস্ত্রাদিতে নাই কিন্তু তন্ত্র-আদি আগম শাস্ত্রে রসতত্ত্বের ‘বিশেষ’ উল্লেখ রয়েছে। এইজন্যেই বলা হয় বাউলতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব খুবই দুরূহ, যার মহত্ব রসিক ভিন্ন বোধ করতে পারে না।
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” মানবদেহকে ঘিরেই সহজিয়া বাউলদের সাধনা। দেহের বাইরে তাঁদের কোনোরূপ সাধনা নাই এবং শাস্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী ক্রিয়াকান্ড সমন্বিত কোনো আনুমানিক ভজনাও তাঁদের নয়। বাউলদের সাধনা বাউলদেরই একান্ত নিজস্ব। বাউলগণ বলে থাকেন – “যা নাই ভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে। যা আছে ভান্ডেতে, তা আছে ব্রহ্মাণ্ডে।” দেহের বাইরে বৈকুন্ঠাদি কল্পনাকে বাউলগণ ‘অনুমান’ বলেন এবং নিজ নিজ দেহভাণ্ডকে তাঁরা ‘বর্তমান’ বলেন৷ সুতরাং বর্তমান দেহ নিয়েই তাঁদের সাধনা, তাঁরা অনুমান মানেন না।”
এতক্ষণে আমরা শুনতে পেলাম – বাউলদের মূল কথাগুলি -অর্থাৎ “ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব”। তাছাড়া বাউলগণের আরও একটি মূল তত্ত্বের কথাও শুনলাম, আর তা হোলো অনুমান ভজন ও বর্তমান ভজন। দেহভান্ডকেই ব্রহ্মাণ্ড মানেন বাউলগণ – তাই দেহভান্ডের বাইরে যা কিছু, তা সে বৈকুন্ঠ হোলেও (যেখানে লক্ষীনারায়ণ থাকেন) তা আনুমানিক। সুতরাং বাউলগণ ওই ধরনের মূর্তিপূজা বা কাল্পনিক দেব-দেবীর উপাসক ন’ন। তাঁরা ‘দেহভান্ডের মধ্যেই সমস্ত তত্ত্ব বিরাজমান’– এটাই মানেন এবং তাই দেহ নিয়েই সাধন করেন, যে সাধনা তাদের একেবারেই নিজস্ব।