শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা* থেকে লাইন তুলে তুলে ধরে__ বাউলমতে বর্ণিত দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, যুগলতত্ত্ব ইত্যাদি সম্বন্ধে সকলে মিলে পাঠগ্রহণ করছিলাম। এই কাজটি করার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পাঠকবৃন্দের কাছে বারবার বলা হয়েছে – হয়তো নিশ্চয়ই বহু পাঠক গুরুমহারাজের নিজের লেখার পাঠগুলি একটু একটু করে পড়ে উপকৃত হোচ্ছেন, অন্ততঃ তাদের একটা ভালোলাগা বোধ তৈরি হোচ্ছে বা অন্য কোনো উপকারও নিশ্চয়ই হোচ্ছে ! কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা আমার ব্যক্তিগত মনে থেকেই যায় – যেটা সবসময়েই থাকে –এইসব করে–এইসব পড়ে আমারও একটু-আধটু উন্নতি হোচ্ছে তো ?
মনে পড়ে যাচ্ছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সময়কালীন একটা ঘটনার কথা। তৎকালীন যুগের বিখ্যাত কীর্তনিয়া-ছড়াকার-পাঁচালীকার নীলকন্ঠ মুখার্জী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে গান শোনাতে এসেছিলেন। সাধক কীর্তনীয়ার সুমধুর কন্ঠের গান শুনে এবং তাঁর মধ্যে ভক্তিভাবের প্রাবল্য দেখে ঠাকুর খুবই প্রসন্ন হয়েছিলেন। গানের শেষে ঠাকুরের কাছে নীলকন্ঠ গোঁসাই এসে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে গেলে__ ঠাকুর তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন – “গোঁসাই ! তুমি কতো বড় মানুষ, তোমার মুখে ঈশ্বরের নাম-গান শুনে কত মানুষ ত’রে (পার হয়ে) যাচ্ছে।” তখন মাথা নত করে, হাতদুটি জোড় করে নীলকন্ঠ গোঁসাই উত্তর দিয়েছিলেন – “সে যা হয় হোক, তবে আপনি শুধু এইটুকু দেখবেন যেন শেষকালে আমি না ডুবি!”
গুরুমহারাজ নিজেও একদিন এই ঘটনার উল্লেখ করে বলেছিলেন – ” দ্যাখো, নীলকন্ঠ গোঁসাই কিন্তু তালে ঠিক ছিলেন। ঠিক জায়গায়, ঠিক সময়ে, ঠিক প্রার্থনাটুকু জানিয়ে রাখলেন।”
এইটাকেই গুরুমহারাজ (বারবার) বলতেন — ‘পরিমিতি জ্ঞান’ বা ‘পরিমিতি বোধ’। আমি কতটা space দখল করতে পারি, আমার কখন, কোথায় প্রবেশের কথা এবং সেখানে কতক্ষণ থাকার কথা এবং কখন প্রস্থানের কথা – সব যথাযথভাবে পালন করাটাই পরিমিতি বোধ ! আমার যাওয়ায়, আমার খাওয়ায়, আমার হাঁটা-চলায়, আমার আচার-ব্যবহারে অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে প্রয়োজন হয় পরিমিতি বোধ ! এই বোধ যার যত বেশি – সমাজে সেই মানুষ ততটাই উন্নত, ততটাই সুসভ্য। আর বর্তমান পৃথিবীতে এইরূপ সুসভ্য মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে – পৃথিবীর পক্ষে ততটাই মঙ্গল। না হোলে, মানুষে মানুষে অকারণে যে হানাহানি-মারামারি-রক্তক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে এবং তার উপর যেভাবে যোগ দিয়েছে প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয়, সঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাস-ঘটিত মহামারী –এতে করে বোঝাই যাচ্ছে যে, বর্তমানের মানবসভ্যতার বিনাশকাল প্রায় সমাসন্ন !
এসব কথা থাক্ – আমরা গুরুমহারাজের চরণের দাসানুদাস। তিনি জগতপতি – সমস্ত জগতের ভার তাঁর ! তাই যেহেতু আমরাও জগৎ-ছাড়া নই, ফলে আমরা কখনই পরমানন্দ-চরণ ছাড়া নই ! – এই আশ্বাস, এই বিশ্বাস, এই ভরসা মাথায় নিয়েই এই জীবনের বাকি দিন ক’টা কেটে যাক পরমানন্দের নাম গুণগান করে !
যাইহোক, এবার আমরা আবার ফিরে আসি গুরুমহারাজের শ্রীহস্ত লিখিত *বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থের কথায়। আমরা এখন উক্ত গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদে প্রবেশ করছি। দ্যাখা যাক্ – সেখানে গুরুমহারাজ কিভাবে বাউল রহস্যের বাকি কথা ব্যক্ত করেছেন।
এবার উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্, সৃষ্টির আদি বা মূল হোলো ‘রস’। সেইজন্য বাউলগণ আদিরসকে “কাম” বলে থাকেন। আদিরস বা কামতত্ত্বই হোলো সৃষ্টির মূল রূপ।”
[এরপর গুরু মহারাজ ‘আদিরস’ বা ‘কামতত্ত্ব’ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার আগে উনি যে পূর্বে কামতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব এবং মদনতত্ত্ব বা রতিরহস্য সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন এবং অঙ্গীকার করেছিলেন যে পরে বিস্তারিত আলোচনা করবেন – সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উনি পুনরায় কথা বলতে শুরু করলেন।] ” প্রিয় আত্মন্ – এই কাম হোলো ত্রিগুণাতীত-মায়াতীত-দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে অপ্রাকৃত শুদ্ধ-দিব্য-প্রেমস্বরূপ। আর এই কাম বা রসই হোলো পরমরসিকশেখর রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ। সেই জন্য বাউলগণ বলেন – শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বটি হোলো অপ্রাকৃত কামতত্ত্ব – কামবীজ ও কামগায়ত্রী যার স্বরূপ এবং তা সহজ-সাধক ভিন্ন অন্য কেহ বুঝতে পারে না৷ আর ঐ কামের শক্তি হোলো রতি। শক্তি ও শক্তিমান অভেদ। সুতরাং রস ও রতি হোলো অভেদ।”
মনে পড়ে যাচ্ছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সময়কালীন একটা ঘটনার কথা। তৎকালীন যুগের বিখ্যাত কীর্তনিয়া-ছড়াকার-পাঁচালীকার নীলকন্ঠ মুখার্জী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে গান শোনাতে এসেছিলেন। সাধক কীর্তনীয়ার সুমধুর কন্ঠের গান শুনে এবং তাঁর মধ্যে ভক্তিভাবের প্রাবল্য দেখে ঠাকুর খুবই প্রসন্ন হয়েছিলেন। গানের শেষে ঠাকুরের কাছে নীলকন্ঠ গোঁসাই এসে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে গেলে__ ঠাকুর তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন – “গোঁসাই ! তুমি কতো বড় মানুষ, তোমার মুখে ঈশ্বরের নাম-গান শুনে কত মানুষ ত’রে (পার হয়ে) যাচ্ছে।” তখন মাথা নত করে, হাতদুটি জোড় করে নীলকন্ঠ গোঁসাই উত্তর দিয়েছিলেন – “সে যা হয় হোক, তবে আপনি শুধু এইটুকু দেখবেন যেন শেষকালে আমি না ডুবি!”
গুরুমহারাজ নিজেও একদিন এই ঘটনার উল্লেখ করে বলেছিলেন – ” দ্যাখো, নীলকন্ঠ গোঁসাই কিন্তু তালে ঠিক ছিলেন। ঠিক জায়গায়, ঠিক সময়ে, ঠিক প্রার্থনাটুকু জানিয়ে রাখলেন।”
এইটাকেই গুরুমহারাজ (বারবার) বলতেন — ‘পরিমিতি জ্ঞান’ বা ‘পরিমিতি বোধ’। আমি কতটা space দখল করতে পারি, আমার কখন, কোথায় প্রবেশের কথা এবং সেখানে কতক্ষণ থাকার কথা এবং কখন প্রস্থানের কথা – সব যথাযথভাবে পালন করাটাই পরিমিতি বোধ ! আমার যাওয়ায়, আমার খাওয়ায়, আমার হাঁটা-চলায়, আমার আচার-ব্যবহারে অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে প্রয়োজন হয় পরিমিতি বোধ ! এই বোধ যার যত বেশি – সমাজে সেই মানুষ ততটাই উন্নত, ততটাই সুসভ্য। আর বর্তমান পৃথিবীতে এইরূপ সুসভ্য মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে – পৃথিবীর পক্ষে ততটাই মঙ্গল। না হোলে, মানুষে মানুষে অকারণে যে হানাহানি-মারামারি-রক্তক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে এবং তার উপর যেভাবে যোগ দিয়েছে প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয়, সঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাস-ঘটিত মহামারী –এতে করে বোঝাই যাচ্ছে যে, বর্তমানের মানবসভ্যতার বিনাশকাল প্রায় সমাসন্ন !
এসব কথা থাক্ – আমরা গুরুমহারাজের চরণের দাসানুদাস। তিনি জগতপতি – সমস্ত জগতের ভার তাঁর ! তাই যেহেতু আমরাও জগৎ-ছাড়া নই, ফলে আমরা কখনই পরমানন্দ-চরণ ছাড়া নই ! – এই আশ্বাস, এই বিশ্বাস, এই ভরসা মাথায় নিয়েই এই জীবনের বাকি দিন ক’টা কেটে যাক পরমানন্দের নাম গুণগান করে !
যাইহোক, এবার আমরা আবার ফিরে আসি গুরুমহারাজের শ্রীহস্ত লিখিত *বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থের কথায়। আমরা এখন উক্ত গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদে প্রবেশ করছি। দ্যাখা যাক্ – সেখানে গুরুমহারাজ কিভাবে বাউল রহস্যের বাকি কথা ব্যক্ত করেছেন।
এবার উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্, সৃষ্টির আদি বা মূল হোলো ‘রস’। সেইজন্য বাউলগণ আদিরসকে “কাম” বলে থাকেন। আদিরস বা কামতত্ত্বই হোলো সৃষ্টির মূল রূপ।”
[এরপর গুরু মহারাজ ‘আদিরস’ বা ‘কামতত্ত্ব’ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার আগে উনি যে পূর্বে কামতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব এবং মদনতত্ত্ব বা রতিরহস্য সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন এবং অঙ্গীকার করেছিলেন যে পরে বিস্তারিত আলোচনা করবেন – সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উনি পুনরায় কথা বলতে শুরু করলেন।] ” প্রিয় আত্মন্ – এই কাম হোলো ত্রিগুণাতীত-মায়াতীত-দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে অপ্রাকৃত শুদ্ধ-দিব্য-প্রেমস্বরূপ। আর এই কাম বা রসই হোলো পরমরসিকশেখর রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ। সেই জন্য বাউলগণ বলেন – শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বটি হোলো অপ্রাকৃত কামতত্ত্ব – কামবীজ ও কামগায়ত্রী যার স্বরূপ এবং তা সহজ-সাধক ভিন্ন অন্য কেহ বুঝতে পারে না৷ আর ঐ কামের শক্তি হোলো রতি। শক্তি ও শক্তিমান অভেদ। সুতরাং রস ও রতি হোলো অভেদ।”