শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদের কথাগুলি এখানে তুলে ধরা হচ্ছিলৈ। এই পরিচ্ছেদে রসতত্ত্ব, কামতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে – আর সেই সব আলোচনা আরো বিস্তারিতভাবে করেছেন গুরুমহারাজ পরবর্তী অংশগুলিতে। সুতরাং আমরা এখন দেখবো গুরুমহারাজ এরপরে আরো কি কি আলোচনা করেছেন।
এরপরে উনি বলেছেন – ” ঐ একই লীলাকারী পরমসত্তা দুই দেহে প্রচ্ছন্ন থেকে লীলারস আস্বাদন করেন। – এই বিষয়ে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করছি, ধৈর্য্যপূর্বক শ্রবন করো !
‘কামতত্ত্বে’র স্ফূরণ হওয়া মাত্রই এক অদ্বৈত বিন্দু ‘দুই’ রূপে প্রকাশিত হোলো, ‘একে’র সহিত ‘দুই’-এর সম্বন্ধ স্থাপিত হোলো। ‘আকৃষ্য’ ও ‘আকর্ষক’ সম্পর্ক শুরু হোলো। একই অদ্বৈত বিন্দু হোতে বিন্দুদ্বয়ের নির্গমন হোতে লাগলো। পুনরায় ঐ বিন্দুদ্বয় সংকুচিত হয়ে ‘একে’তে লীন হোতে লাগলো। এই হোলো ‘বিন্দু বিসর্গের’ খেলা। বিন্দু হোলো চিৎ এবং বিসর্গ হোলো আনন্দ – এই তত্ত্ব উপনিষদেও ব্যক্ত রয়েছে।
” আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাং। আনন্দাদ্ব্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। আনন্দেন জাতানি জীবন্তি। আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তীতি।” [ “আনন্দই ব্রহ্ম(ভৃগু) ইহা জানিলেন। কারণ আনন্দ হইতেই এই ভূতবর্গ জাত হয়, জাত হইয়া আনন্দের দ্বারা বর্ধিত হয় এবং অবশেষে আনন্দাভিমুখে প্রতিগমন করে ও আনন্দে বিলীন হয়।”]
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! আমরা স্বয়ং ভগবান মহাবাউল গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের স্বহস্তে লেখা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি তুলছি আর এইগুলির মর্মার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। আর আমরা (সকল পাঠকেরা) সকলেই বেশ বুঝতে পারছি – এই কাজটি কতটা দূরহ !! তবু আমরা যেটা উক্ত কথাগুলি থেকে বুঝতে পেরেছি সেটা হোলো – ‘একই পরমসত্তা দুই দেহে প্রচ্ছন্ন থেকে লীলারস আস্বাদন করে থাকেন’। কিন্তু এরপরে যেটা গুরুমহারাজ বললেন সেটাই অনুধাবন করাটা মুশকিল হোচ্ছে। কারণ ঐ যে উনি বললেন – ‘অদ্বৈত বিন্দু থেকে ‘দুই’ রূপে প্রকাশিত হবার মূল কারণ হোলো সেই ‘এক’-এর মধ্যে ‘কামতত্ত্বে’-র স্ফূরণ হওয়া।’ তাছাড়া উনি আরো বললেন –’ ‘আকৃষ্য ও আকর্ষক’ সম্পর্ক শুরু হোলো।’
প্রিয় পাঠক – এই যে নরনারী পরস্পরের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ – এর মূল কারণটা তাহলে বুঝতে পারছেন কি? একেবারে সৃষ্টির শুরুতেই এই আকর্ষণ তৈরি হয়ে রয়েছে। সেইজন্যেই তো নিম্নতর প্রাণী থেকে এই পৃথিবী গ্রহের সর্বোন্নত জীব মানুষ পর্যন্ত সব জীবেরই পুরুষ ও নারীর মধ্যে মিলনের জন্য সুতীব্র আকর্ষণ বিদ্যমান। আর এইজন্যেই বাউলগণের রমণী নিয়ে সাধন স্থূল রমণের ইচ্ছাকে প্রশমিত করে সাধনার দ্বারা সূক্ষ্ম ও কারণ-জগৎ অতিক্রম করে প্রকৃত শৃঙ্গাররসের আস্বাদনই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
যাইহোক, যে উদ্ধৃতি আগে তোলা হয়েছে সেখানে ‘বিন্দু-বিসর্গের খেলা’-র ব্যাখ্যা করেছেন গুরুমহারাজ। আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, “এই ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গও বুঝলাম না !” এখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, ‘বিন্দু-বিসর্গ’ বোঝা কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! সেই এক অদ্বৈত পরমতত্ত্ব বা পরমেশ্বরতত্ত্ব বিন্দুরূপে ছিলেন, সেখান থেকে ‘দুই’ অর্থাৎ দুটি বিন্দু বা বিসর্গ সৃষ্টি হয়েছিল কামতত্ত্ব বা রসতত্ত্ব পরমানন্দ আস্বাদনের জন্য। পরমতত্ত্বের আনন্দ আস্বাদন বা ব্রহ্মের রমণেচ্ছার সমাপ্তি ঘটলে ওই ‘দুই’ বা বিসর্গ সংকুচিত হয়ে আবার পূর্বের ‘এক’ অবস্থায় বা ‘বিন্দু’-র স্থিতিতে ফিরে যায় – এটাই বিন্দু-বিসর্গের খেলা !
বাবা রে বাবা ! এতো মহাসাংঘাতিক ব্যাপার ! ঐ কথাগুলির মানেটা কি দাঁড়ালো বলুন তো ? – বিন্দু-বিসর্গের খেলা বলতে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় এই সমস্ত কিছুর রহস্য অবগত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার মানে আমরা ঠিকই বলি – “এইসব কিছুর বিন্দু-বিসর্গও আমরা বুঝি না !” কিন্তু এখানে একটা ধন্দ রয়েই গেল, আর সেটা হোলো – আমরা জানি ব্রহ্মকে সচ্চিদানন্দ বলা রয়েছে অর্থাৎ সৎ-চিৎ-আনন্দ ! গুরুমহারাজ বিন্দুকে বললেন ‘চিৎ’ এবং বিসর্গকে বললেন ‘আনন্দ’। তাহলে ‘সৎ’ অবস্থাটা কি ? এটা তাহলে বিন্দুরও পূর্ববর্তী অবস্থা কি ? কারন আমরা জানি – ‘সৎ’ অর্থে অস্তি বা যা আছে – এটাই স্থিতি, বাকি সবকিছুই দশা, যা সতত পরিবর্তনশীল ! সেই অর্থে এটাও বলা যায় কি – ঐ যে বিন্দু অবস্থা – ঐ অবস্থাও নিত্য নয়, স্থিতি অবস্থা নয় – ঐ অবস্থারও পরিবর্তন হয় !! – নাকি সৎ-চিৎ-আনন্দ এই তিনে ‘এক’ এবং একে ‘তিন’ !?!
এরপরে গুরুমহারাজ তৈত্তিরীয় উপনিষদের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ষষ্ঠ শ্লোকের উল্লেখ করে বলেছেন – এই পৃথিবীর সকল কিছু আনন্দ হোতে সৃষ্টি হয়েছে, আনন্দতেই বিধৃত রয়েছে এবং আনন্দেই সবকিছু লয়প্রাপ্ত হোচ্ছে।৷