শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি – গুরুমহারাজ সহজিয়া বাউলমতের ‘পরমেশ্বর তত্ত্বে’র বর্ণনা করেছিলেন। সেখানে আমাদের মনে হয়েছে যে, উপনিষদাদি শাস্ত্রে ব্রহ্ম-কে শাশ্বত-নিত্য-সনাতন-অদ্বৈত_অবাঙমনসাগোচর ইত্যাদি শব্দ দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে আমরা পাই অক্ষর ব্রহ্ম এবং ক্ষর ব্রহ্মের কথা। অক্ষর ব্রহ্মের বহু হবার ইচ্ছা জাগ্রত হওয়ার থেকেই ক্ষর ব্রহ্ম অর্থাৎ পরম পুরুষ ও পরমা প্রকৃতির সৃষ্টি হয়। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বক্তব্য ইত্যাদি দ্বারা ক্ষর ব্রহ্ম পর্যন্ত বর্ণনা করা যায়, কিন্তু অক্ষর ব্রহ্ম বা পরব্রহ্মকে কোনোভাবেই ব্যক্ত করা যায় না, চিন্তাও করা যায় না – তাই তাঁকে অব্যক্ত, অচিন্ত্য ইত্যাদিও বলা হয়ে থাকে।
অপরপক্ষে আমরা সহজিয়া বাউলমতের দর্শন থেকে জানলাম যে, এখানে পরমেশ্বরকে ‘শ্রীকৃষ্ণ’ নামে ভূষিত করা হয়েছে এবং এই পরমেশ্বরের অঙ্গকান্তি বা জ্যোতিঃ-ই হোলো ‘ব্রহ্ম’ ! সেই অর্থে ‘ব্রহ্ম’ জ্যোতিঃস্বরূপ ! বাউলগণ এঁকেই ‘নিরঞ্জন’ বলে থাকেন। যোগী, সিদ্ধ এবং মুক্তপুরুষগণ এই জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মের-ই ধ্যান করেন (চিত্ত প্রণিধান করেন)। পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ বা পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, যিনি নিত্যবৃন্দাবনে, ব্রজপুরে বা সহজপুরে নিত্যবিহারশীল, যিনি চিরকিশোর, যাঁর অঙ্গচ্ছটা হোলো জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্ম এবং এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-বিশ্বচরাচর যে জ্যোতিঃ থেকে সৃষ্টি হয়েছে – সেই পূর্ণব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ আবার আকারবিশিষ্ট, কারণ তিনি দ্বিভূজ নরাকার !!
যাইহোক, এবার আমরা আরও একটু বাউলের মর্মকথা গ্রন্থের সামনের দিকে অগ্রসর হই। আমরা এখন দেখবো, এই গ্রন্থের ‘পঞ্চম পরিচ্ছেদে’র ছত্রে ছত্রে তিনি আরও কতো রহস্য উন্মোচিত করেছেন ! এরপরে উনি ভক্তের জিজ্ঞাসা ও গুরুর উত্তর – এই আকারে পরবর্তী আলোচনাগুলি সাজিয়েছেন। ফলে আমরাও ‘প্রশ্ন ও উত্তর’-এর প্রশ্নটা সংক্ষিপ্ত আকারে এবং উত্তরটা পুরোটাই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অবশ্য এখানে একটা কথা পরমানন্দ ভক্তদের মধ্যে আসতেই পারে যে, এখানে জিজ্ঞাসা-উত্তর না হয়ে প্রশ্ন-উত্তর হোলো কেন ? এর একটা কারণ হোতে পারে যে, এখানে জিজ্ঞাসাটাও গুরুমহারাজ স্বয়ং তুলেছেন এবং উত্তরও উনি নিজে দিচ্ছেন – তাই জিজ্ঞাসা-উত্তর না হয়ে প্রশ্ন-উত্তর হয়েছে।
” প্রশ্ন :– যেহেতু পূর্বে বলা হয়েছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরে সহজিয়া মতবাদের পূর্ণবিকাশ সম্ভব হয়েছিল, তাহলে চৈতন্যভক্তগণ তথা বৈষ্ণবগণ সকলেই কি সহজিয়া সাধন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন – না তাদের অন্য সাধন পদ্ধতিও ছিল ?”
এর জিজ্ঞাসার উত্তরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর কাল হোতেই বৈষ্ণবজগতে দুটি ধারার প্রচলন হয়ে আসছে এবং উভয় সম্প্রদায়ের ইষ্ঠদেব হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। উভয়ের আশ্রয়স্থল হোলো শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ। কিন্তু সাধনার পদ্ধতিতে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় হোতে সম্পূর্ণ বিপরীত। সাধনার পদ্ধতি ভিন্ন হোলেও এঁদের উৎপত্তিস্থল এবং গন্তব্যস্থল একই। তথাপি এঁদের বিবাদের একমাত্র কারণ হোলো – একপক্ষ ‘অনুমান ভজনে’ আস্থাশীল এবং অপরপক্ষ ‘বর্তমান ভজনে’ আস্থা রাখেন।
‘অনুমান ভজনে’-র তাৎপর্য হোলো যে, এঁরা নারী বা প্রকৃতি বর্জিত হয়ে মানসভাবে প্রকৃতিভাব নিয়ে অষ্টপ্রহর চিন্তা দ্বারা শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটিয়ে যুগল মিলনাত্মক শৃঙ্গার রসাস্বাদন করে থাকেন। আর ‘বর্তমান ভজন’-এর তাৎপর্য হোলো যে, এঁরা নারী বা প্রকৃতি গ্রহণ করে যোগের দ্বারা ঊর্ধ্বরেতা হয়ে স্বীয় দেহের অভ্যন্তরে স্বরূপতত্ত্বে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমিলনাত্মক শৃঙ্গাররস অনুভব করে থাকেন এবং স্বরূপতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হ’ন।
এই ‘অনুমান ভজন’ যাঁরা করেন, তাঁরা ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ নামে পরিচিত এবং যাঁরা ‘বর্তমান ভজন’ করেন, তাঁরা ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ নামে পরিচিত।
প্রিয় আত্মন্‌ – বাংলাদেশে এঁরা আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই এবং সহজ নামে পরিচিত। এঁরাই নারী প্রকৃতি নিয়ে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল সাধন-ভজন করেন। অর্থাৎ নর-নারী উভয়ে সাধন প্রক্রিয়া দ্বারা ঊর্ধ্বরেতা হয়ে শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিথুন ভাবগত-লীলারস বা শৃঙ্গার রসাত্মক চরম মাধুর্য্য আস্বাদন করে থাকেন।
প্রিয় আত্মন্‌ ! এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে – ‘অনুমান ভজনে’ নারীর সাহচর্য্যের প্রয়োজন নাই, কিন্তু ‘বর্তমান ভজনে’ সাধকগণের কেবলমাত্র নারীর সাহচর্য্যের প্রয়োজন হয়।”
পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজের উপরিউক্ত কথাগুলি থেকে ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ এবং ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ সম্বন্ধে আমরা অনেক কথাই বুঝতে পারলাম, আর বুঝলাম তাঁদের ‘অনুমান ভজন’ এবং ‘বর্তমান ভজন’ সম্বন্ধেও। যদিও উভয় মতের-ই উপাস্য মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব এবং এদের উভয়েরই প্রামাণ্য গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। ‘অনুমান ভজন’-কারীরা নারী বা প্রকৃতি গ্রহণ করেন না – নিজের অন্তঃর্জগতের প্রকৃতিভাব জাগ্রত করে সাধন ভজনের দ্বারা সহস্রারে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল-মিলন জনিত শৃঙ্গার রসাস্বাদন করেন। অপরপক্ষে ‘বর্তমান ভজন’-কারীরা – যাদেরকে আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই বা সহজ নামে অভিহিত করা হয়– তাঁরা ‘নারী’ নিয়ে সাধন করেন এবং যোগসাধনার দ্বারা ঊর্ধ্বরেতা হয়ে নিজ দেহাভ্যন্তরে স্বরূপতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যুগল মিলনানন্দ শৃঙ্গাররস অনুভব করে থাকেন।৷