শ্রীশ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র পঞ্চম পরিচ্ছেদে লিখিত কথায় ছিলাম। আমরা এখন দেখবো যে, উনি ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ ও ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ এবং ‘অনুমান ভজন’ ও ‘বর্তমান ভজন’ নিয়ে আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে গুরুমহারাজ ‘বর্তমান ভজন’ যাঁরা করেন সেই বাউলমতের দুইটি ধারা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – বর্তমান বাউলদের দুই ধারার প্রথম ধারায় রামানন্দ, জয়দেব, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস প্রভৃতি জ্যোতিষ্কগণ পড়েন। আর দ্বিতীয় ধারার অন্তর্ভুক্ত শ্রীরূপ-সনাতন, শ্রীজীব, রঘুনাথ দাস, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি প্রভুপাদগণ।
প্রথম ধারাটির সকলেই গৃহস্থী ছিলেন, আর দ্বিতীয় ধারাটির সকলেই সন্ন্যাসী ছিলেন, অর্থাৎ প্রথম ধারাটি-(র সকলে) প্রকৃতি গ্রহণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ধারাটি-(র সকলে) এককভাবেই বর্তমান সাধনা করেছিলেন।
প্রিয় আত্মন্ – আজও অসংখ্য সাধু-মহাজন এককভাবে বর্তমান ধারাতে সাধনা করে চলেছেন। বর্তমান সাধনার উদ্দেশ্য বা মূল কথাটি হোলো ঊর্ধ্বরেতা হওয়া এবং চিন্ময়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপ্রাকৃত আনন্দরস আস্বাদন করা।
এই একক বর্তমান ভাবের সাধকগণ মধুরভাব আশ্রয় করে ঐ চরম অবস্থায় উপনীত হ’ন। সমস্ত ভাবের পূর্ণতা মধুরভাবের মধ্যে আর মধুরভাবের চরম পরিণতি মহাভাব, যার মধ্যে রয়েছে প্রেম-মিলনের চরম শৃঙ্গারাত্মক রসােল্লাস।৷”
প্রিয় পাঠক, তাহলে কি বোঝা গেল বলুন তো __প্রথমে আমরা জেনেছিলাম যে, মহাপ্রভুর সময় থেকেই আমাদের এখানকার বৈষ্ণবসমাজ দুইটি ধারায় বিভক্ত ছিল – ‘সহজিয়া বৈষ্ণব’ ও ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’ অর্থাৎ ‘বর্তমান মতের ভজনকারী’ ও ‘অনুমান মতের ভজনকারী’৷ আর এখন আমরা জানতে পারলাম যে, বর্তমান মতের সাধন করেন যাঁরা – তাঁদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ রয়েছে, তার প্রথমটির সাধকেরা (রামানন্দ, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জয়দেব প্রমূখ) নারী বা প্রকৃতি গ্রহণ করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এঁরা বৈষ্ণব সমাজে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কস্বরূপ এবং দ্বিতীয় ধারাটির সাধকেরা (শ্রীরূপ-সনাতন, শ্রীজীব, রঘুনাথ দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখরা) নারী বা প্রকৃতি বর্জিত সাধন করেছিলেন অর্থাৎ বর্তমান সময়ের সন্ন্যাসীদের ন্যায় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।৷
গুরুমহারাজ আরও বলেছেন – ‘আজাে বহু বাউল-বৈষ্ণব সাধক ‘বর্তমান’ মতের সাধন একাকীই করে চলেছেন। তাঁরা সাধন সহায়ে ঊর্ধ্বরেতা হয়ে চিন্ময়স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হ’ন এবং অপ্রাকৃত আনন্দরস আস্বাদন করেন।’ কিন্তু এই সাধন পথটি কি? – সে কথাও বলেছেন গুরুমহারাজ। উনি বলেছেন – ‘এককভাবের সাধকগণ মধুরভাব আশ্রয় করে ঐ চরম অবস্থায় উপনীত হ’ন। বৈষ্ণবমতে যে পাঁচটি ভাবের সাধনা রয়েছে, সেগুলি হোলো – দাস্য, সখ্য, শান্ত, বাৎসল্য ও মধুর। এই সমস্ত ভাবের পূর্ণতা মধুরভাবের মধ্যে। মধুরভাবের চরম পরিণতি হোলো ‘মহাভাব অবস্থা’ যা শ্রীরাধিকার ভাব। আর এই মহাভাব অবস্থার মধ্যেই রয়েছে শ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রেম-মিলনের চরম শৃঙ্গারাত্মক রসােল্লাস !’
এরপরে গুরুমহারাজ ‘মধুরভাব’ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – সর্বভাবের পরিসমাপ্তি মধুরভাবে, আর এই মধুরভাবের লীলাই হোলো ব্রজলীলা। এই মধুরভাবটিকে কেন্দ্রে রেখে অন্যান্য যাবতীয় ভাবসকল তার চারিদিকে স্থিতিলাভ করে। যে কোনভাবেই সাধক অবস্থান করুক না কেন, চরম অবস্থায় তাঁকে মধুরভাব আশ্রয় করতেই হবে। সেইজন্যেই মধুরভাবকে ‘চরমভাব’ বলে। বাউলগণ বলেন – মধুরভাব আশ্রয় না করলে শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলারস মাধুর্য্য বা যুগলতত্ত্ব জানা যাবে না। কারণ প্রকৃতি না হয়ে প্রকৃতির লীলা আস্বাদন করা অসম্ভব। যদিও সমস্ত ভাবই মহাভাবের অন্তর্গত, তবুও অন্যান্যভাবে পুরুষকারের আভাস রয়েছে অর্থাৎ কিঞ্চিৎ পরিমান পুরুষভাব বিদ্যমান থাকে। একমাত্র মধুর ভাবেতেই এই পুরুষভাব সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সেইজন্য মধুর ভাবেই কেবল শৃঙ্গারাত্মক রসের স্ফুরণ হয়, আর এই উল্লাস ‘উজ্জ্বল রস’ নামে খ্যাত। মধুরভাব আশ্রয় বা অবলম্বন করলে সাধকের প্রকৃতিতে বা অন্তর্জগতে ক্রমান্বয়ে – ‘অভাব’ হোতে ‘স্বভাব’ এবং স্বভাব হোতে ‘মহাভাব’ অবস্থার উন্মেষ হয়। এই মহাভাব অবস্থার ভিতরই চিৎকলার সম্পূর্ণ বিকাশ হয়। আর চিৎকলার বিকাশ হোলেই অমৃতময়ী ষোড়শী কলার অভিব্যক্তি হয়। তাই হোলো হ্লাদিনী-স্বরূপিণী শ্রীরাধা ! আর এটাই হোলো মধুর-ভাবের গূঢ়তম রহস্য।”