শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা অনেকদিন ধরে তাঁর লিখিত বা কথিত কথাগুলিই আলোচনা করে যাচ্ছি। তাঁর সম্বন্ধে কোনো কথা আর বলাই হয়ে উঠছে না। আজকে একটু বলা যাক্। আজ সকালে আমার (20/10/2022) মনে পড়ে যাচ্ছিলো সেইসব দিনের কথা অর্থাৎ ‘পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা’ !
আমার এক গুরুভাই সেইসময় (১৯৮৯-৯০ সালে হয়তো) আমাকে একদিন তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো – ” দেখেছো আমার ঘরে কতো গানের ক্যাসেট (তখন বাড়িতে টেপ-রেকর্ডার এবং তাক ভর্তি সারে সারে রাখা ফিতা লাগানো ক্যাসেটের collection রাখাটা একটা বাহাদুরীর ব্যাপার ছিল, এতে করে সে বোধহয় বোঝাতে চাইতো_ ঐ ব্যক্তিটি খুবই cultural বা সংগীতপ্রেমী বা এইরকম কিছু একটা !)! আমি অমুক শিল্পীর গান শুনতে খুবই ভালোবাসি – ওর গানের ক্যাসেট বেরোলেই আমি কিনে ফেলি। এতো সুন্দর গাইছে না – আমি তো ওর গান শোনার জন্য পাগল।” সেই ছেলেটির (এখন সে প্রায় প্রৗেঢ়, তার ছেলেরই বিবাহ দেবার সময় হয়ে গেল!) ঐ রকম একটা ভাব দেখে আমার সে কি যে অবাক লেগেছিল – তা আপনাদের কি বলবো !
আমার মনে হয়েছিল_ গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দকে দেখার পর আবার কেউ অন্যকিছুর জন্য বা অন্য কারোর জন্য এতোটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নাকি ! অবাক হবার মতো, আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার মতো, গর্ব বা অহংকার প্রকাশ করার মতো তো এই পৃথিবীতে একজনই রয়েছে – আর সেটা হোলো আমাদের পরমারাধ্য পরমপ্রিয় শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ !! তখন আমাদের (১৯৮৩/৮৪, যখন আমি প্রথম গুরুজীকে দেখেছিলাম বা বনগ্রামে গেছিলাম) যুবক বয়স, তাই স্বাভাবিকভাবেই তখন আমাদের মনজগতেও উত্তম কুমার, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন ইত্যাদি flimstar-দের একটা image গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবেও কিছু মানুষের (নারী ও পুরুষ) রূপ বা গুণের ছাপও আমাদের মনে একটু-আধটু হোলেও রেখাপাত করেছিল। কিন্তু যখন গুরুমহারাজকে দেখলাম, তাঁর কাছাকাছি যাবার সুযোগ পেলাম – তখনই ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম সুন্দর কাকে বলে – সৌন্দর্য্য কাকে বলে – গুণ কাকে বলে – গুণের মানুষ কাকে বলে – আধ্যাত্মিকতা কাকে বলে – আধ্যাত্মিক মানুষ, সহজ মানুষ, মনের মানুষ, মনের মতো মানুষ কাকে বলে !! ফলে, তখন আর অন্য কোনো field-এর কোনো গুণী মানুষের গুণ, কোনো রূপবান মানুষের রূপ আর আলাদা করে চোখে পড়তো না, কোনো কিছুই সেভাবে চোখে পড়তো না ! তখন সব ভালোকিছুর মধ্যেই আমরা গুরুমহারাজকে দেখতাম অথবা গুরুমহারাজের মধ্যেই আমরা সবকিছু ভালো খুঁজে পেতাম ! সত্যি সত্যিই আমরা বাইরের জগতে কোনো মানুষের মধ্যে যতকিছু ভালো দেখে আমরা অবাক হতাম অথবা অনুরাগী হয়ে পড়তাম (গুরুমহারাজকে দেখার আগে)_ গুরুমহারাজকে দেখার পর – তাঁর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাওয়ার পর, সেইসমস্ত ভালো – কোনো না কোনোসময়ে গুরুমহারাজের মধ্যে ফুটে উঠতো – গুরুমহারাজের চালচলনে, কথাবার্তার মধ্যে, হাসির মধ্যে প্রকাশ পেতো !
আগে একদিন আমাদের গুরুভাই আশীষ মাস্টারমশাই-এর উল্লেখ করেছিলাম (শ্রীধরপুরের আশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়), সেদিন কথাপ্রসঙ্গে উনিও এই একই কথা বলছিলেন। উনি বলছিলেন – “হাইস্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজতো বিকেল ৪টায়। আমি (আশীষ বাবু) ব্যাকুল হয়ে থাকতাম কখন ঘন্টা বাজবে। যেই ঘন্টা বাজা – অমনি সাইকেল নিয়ে প্রায় ১৪/১৫ কিমি রাস্তা (শ্রীধরপুর থেকে বনগ্রাম আশ্রম) অতিক্রম করে একেবারে সোজা বনগ্রামে গুরুজীর সিটিং-এ হাজির হোতাম। আমার সহকর্মী টিচারেরা অবাক হয়ে বলতো – ‘তোর ব্যাপারটা কি ? কিসের তোর এতো টান?’ আমি তো ওদেরকে বোঝাতে পারতাম না – সেই টান যে কি বিষম টান ! পরে ধারণা করেছিলাম যে, বৈষ্ণবশাস্ত্রে আমরা যে ‘পূর্বরাগ’- ‘নব অনুরাগের বর্ষা’- ইত্যাদি কথাগুলি পাই, গোপীদের শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণের কথা পাই – সেগুলি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছিল।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! আমাদের মধ্যে যাঁদের গুরুমহারাজের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ হয়েছিল, তাঁর কৃপা-করুণা-ভালবাসা লাভের অভিজ্ঞতা হয়েছিল – তারা সকলেই উপরিউক্ত কথাগুলিকে অনুভব করতে পারবেন। আর যারা পড়ে এসেছে – তারা অন্ততঃ ধারণা করার চেষ্টা করবেন এবং নিশ্চয়ই জানবেন প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে যে সমস্ত কথা লেখা রয়েছে – সেগুলো সবই সত্যি, একেবারে খাঁটি সত্যি ! হয়তো কোথাও কোথাও একটু জল মিশেছে (যেগুলি পরবর্তীতে কোন পন্ডিত সংযোজন করেছে)– কিন্তু ষোলো আনার মধ্যে পনেরো আনা সত্য ! যাদের জীবনে সত্যের ধারণা হয়, অনুভব হয়, বোধ হয় – অর্থাৎ এককথায় ঈশ্বরের কৃপালাভ হয় – তাদের আর মহাজনবাক্য বিশ্বাস না করে কোনো উপায় থাকে না !
গুরুমহারাজের যেটুকু সঙ্গলাভ আমাদের হয়েছিল, যেটুকু কৃপা তিনি আমাদেরকে করেছিলেন – তাতে আমরা এইটুকু বুঝেছি যে, প্রতিটি মানুষই ঈশ্বরের মাধুর্য্যলাভ করতে পারে (ঐশ্বর্য্যও লাভ করতে পারে)– কিন্তু তার জন্য তো প্রচেষ্টা প্রয়োজন – প্রযত্ন প্রয়োজন ! এমনি এমনি তো কিছুই লাভ হয় না – স্থুলজগতের রত্নই লাভ হয় না তো পরমার্থ কি করে লাভ হবে ? শুধু শুধু ‘ঈশ্বর আছে – ঈশ্বর নাই’ বা ‘আমার মতটা ঠিক – তোমারটা ভুল’ ইত্যাদি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা বা হানাহানি করায় কি হবে ? এই জগৎ তো ‘জ্যায়সা কা ত্যায়সা’ ! তুমি তোমার চেষ্টা দ্বারা অনেক কিছুই করতে পারো– পরস্পরে পরস্পরের প্রতি দল পাকাতে পারো, মারামারি-হানাহানি করতে পারো – কিন্তু সেই মহাশক্তিমান পরমেশ্বরের বিধান কি পাল্টাতে পারো ? এই ভাবনা চরম আহম্মকি নয় কি ?? তাই অযথা সময় নষ্ট না করে নিজের অন্তঃর্জগতে খোঁজা শুরু করে দেওয়া দরকার। একটু নির্জনে বসে ধ্যান করাটা একান্ত প্রয়োজনীয় ! তাহলে নিজের মধ্যেই সমস্ত জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়া যায়। আর এটা ধ্রুব সত্য কথা।৷