শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্তের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র পঞ্চম পরিচ্ছেদের কথায়। যেখানে গুরুজী মানুষের চেতনার উত্তরণের কথা বলেছিলেন অর্থাৎ অভাব থেকে স্বভাবে এবং স্বভাব থেকে মহাভাবে উত্তরণের কথা ! এখন আমরা দেখবো এরপরে গুরুমহারাজ এই ব্যাপারে আরো কি কি বলেছেন।
এরপরে উনি বলেছেন – ” এই অভাব অবস্থায় তমঃ ও রজঃগুণের প্রভাবে চিত্ত সর্বদা অস্থির ও চঞ্চল হয়ে পড়ে এবং অসহিষ্ণুতাহেতু মনের মধ্যে প্রচন্ড বিক্ষোভ চলতে থাকে। কোনো বিষয়ে কিছুক্ষণের জন্যও মন একাগ্র হয় না। এই অবস্থায় সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গের একান্ত প্রয়োজন। ক্রমশঃ সাধনার দ্বারা তমঃ ও রজঃগুণের প্রভাব দূর হোলে মানব সত্ত্বপ্রধান হয়। যথাক্রমে অনুবৃত্তি-উপবৃত্তি-বৃত্তি হোতে ভাব অবস্থার উদয় হয়। আর এই ভাব অবস্থাই হোলো সত্ত্বপ্রধান মানবের লক্ষণ। ক্রমশঃ সত্ত্বগুণ প্রধান ব্যক্তির মধ্যে বিশুদ্ধ সত্ত্বগুনের উন্মেষ হয়৷ তখন ভাব ক্রমান্বয়ে গাঢ়তাপ্রাপ্ত হয়ে এক প্রগাঢ় ঘনীভূত অবস্থার অভিব্যক্তি হয়। আর ভাবের ঐ ঘনীভূত অবস্থাই হোলো প্রেম। এটাই হোলো অভাব হতে স্বভাবে উপনীত হওয়া !”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ – গুরুমহারাজ আমাদের মতো মানুষের অবস্থা বা অভাব অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। এই অবস্থায় মানুষের মধ্যে ত্রিগুণের মধ্যে তমঃ ও রজঃগুণের প্রভাব অধিক ক্রিয়াশীল হয়, ফলে সাধারণ মানুষের চিত্ত সর্বদা অস্থির ও চঞ্চল হয়ে থাকে, মানুষ – অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে এবং তার জন্যই মানুষের মধ্যে প্রচন্ড বিক্ষোভ চলতে থাকে। এইজন্যেই সাধারণ মানুষেরা ( অবশ্যই আমাদের বেশিরভাগই এই দলেই রয়েছি) কোনোমতেই তাদের মনকে একাগ্র করতে পারে না।
কিন্তু এই অবস্থা থেকেও তো মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে, এবার গুরুমহারাজ সেই বিধানও দিয়েছেন। উনি বলেছেন যে, এই অবস্থা থেকে মানুষ একমাত্র মুক্ত হোতে পারে যদি তার সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গ লাভ হয় অর্থাৎ সেই ব্যক্তি সদ্গুরুর সন্ধান পায়। সদ্গুরুর সংস্পর্শে এলে – গুরু ঐ মানুষটির মনোজগতে চলতে থাকা চিন্তার প্রবাহের অভিমুখটা একটু পাল্টে দেন, গুরু ঐ ব্যক্তিকে মন্ত্রদীক্ষা দান করেন। মন্ত্র অর্থাৎ ‘মন-কে যা ত্রাণ করে’ ! সতত নিম্নমুখী মন ধীরে ধীরে ঊর্দ্ধগামী হয় অর্থাৎ মানব তমঃ ও রজঃগুণের প্রভাব মুক্ত হোতে থাকে মন্ত্র-জপ-সাধনা-ধ্যান ইত্যাদির দ্বারা। আর তখন থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে সত্ত্বগুণের অধিকারী হোতে থাকে এবং শেষে সত্ত্বপ্রধান হয়ে ওঠে।
এরপরে গুরুমহারাজের মানবের অন্তর্জগতের কিছু বৃত্তির উত্তরণের কথা বলেছেন যেগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় নাই বলে ঠিক বুঝতে পারিনি। উনি বললেন, অনুবৃত্তি-উপবৃত্তি-বৃত্তি এই ক্রম বেয়ে উন্নত হোতে হোতে মানবের অন্তর্জগতে ‘ভাবে’-র উদয় হয়৷ আর এই ‘ভাব অবস্থা’-ই হোলো সত্ত্বপ্রধান মানবের লক্ষণ। সাধকের একনিষ্ঠ সাধনা এবং গুরুর প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি বজায় থাকলে (অর্থাৎ নিয়মিত সৎসঙ্গ ও সাধুসঙ্গ করতে থাকলে) ক্রমশঃ সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তির মধ্যে বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের উন্মেষ হয়। এই অবস্থায় ‘ভাব’ প্রথমে গাঢ়তা প্রাপ্ত হয় এবং পরে আরো প্রগাঢ় ঘনীভূত অবস্থার অভিব্যক্তি ঘটে। এই যে প্রগাঢ় ঘনীভূত অবস্থা – ভাবের এই বিশেষ অবস্থাই হোলো ‘প্রেম’। এইভাবেই সাধকের প্রকৃতিতে বা অন্তর্জগতে ‘অভাব’ অবস্থা হোতে ‘স্বভাব’ অবস্থার উত্তরণ ঘটে থাকে।
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” আবার ঐ প্রেম ক্রমান্বয়ে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ ও ভাব হয়ে মহাভাবে পরিণতি লাভ করে। মহাভাব অবস্থা হোলো ত্রিগুনের পরে – তাই অপ্রাকৃত। ইনি (এই অবস্থাই) হ্লাদিনীস্বরূপিনী শ্রীরাধা।
সুতরাং এখন নিশ্চয়ই বুঝলে সাধকের চিত্ত যখন ত্রিগুণ বিকার দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে, তখন অভাব অবস্থা। ক্রমান্বয়ে অনুবৃত্তি, উপবৃত্তি, বৃত্তি হয়ে হয় ‘ভাব’। এই ‘ভাব’ ক্রমশঃ গভীর হয়ে হয় স্বভাব (প্রেম) এবং স্বভাবের চরম ও পরম অভিব্যক্তি হোলো মহাভাব অর্থাৎ শ্রীরাধা ( এরপরে গুরুমহারাজ আরো এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।)৷৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ – এই অংশে গুরুমহারাজ পুরো বিষয়টির খুব সংক্ষেপে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আমাদের আর নতুন কিছু বলার নাই। শুধু এই stanza-র প্রথম লাইনটা আরো একবার উল্লেখ করতে চাই, যেখানে উনি বলেছেন –’প্রেম-ই ক্রমান্বয়ে স্নেহ, মান, প্রণয়, রাগ, অনুরাগ ও ভাব হয়ে মহাভাবে পরিণত হয়।’ এ এক দীর্ঘ অন্তর্জগতের অভিব্যক্তি বা বিবর্তন যা বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না – যা কিছু পরিবর্তন-বিবর্তন হয় – তা সাধকের অন্তর্জগতেই। এছাড়া আর একটা বিষয়ের সংজ্ঞা আমরা এখানে পেলাম, আর তা হলো – ‘অপ্রাকৃত’ বলা হয় তাকেই, যা ত্রিগুণের পারে।
সেইজন্যেই ‘মহাভাব’ অবস্থাকে ‘অপ্রাকৃত’ বলা হয়েছে এবং এই অবস্থাই হ্লাদিনীস্বরূপিণী শ্রীরাধা।।