শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত), “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”-নামক ধারাবাহিক প্রবন্ধে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন গুরুমহারাজের স্বহস্তে রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা -র ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের কথায় ছিলাম। এই পরিচ্ছেদে গুরুমহারাজ বাউলগণের সাধনা ও তাঁদের মতামত (দর্শন বা philosophy) সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। আমরা ছিলাম সেইসব কথায়। এখন আমরা দেখবো_ এই সম্বন্ধে গুরুজী আরো কি কি বলেছেন।
এরপরে উনি বলেছেন – ” বৈষ্ণবশাস্ত্রমতে ভক্তি সাধনায় দুটি ব্যবস্থা স্বীকৃত আছে। তার মধ্যে একটি হোচ্ছে বৈধী এবং অপরটি অবৈধী, অর্থাৎ একটি শাস্ত্র-বিধানসম্মত বিধি মেনে চলে এবং অপরটি ভাবাশ্রিত বা রাগানুগা।৷
সহজিয়া বাউলগণ তাঁদের সাধনা পদ্ধতিকে ‘রাগের ভজন’ বলে থাকেন। তাঁরা কোনো প্রচলিত শাস্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী ক্রিয়াকান্ডযুক্ত অনুষ্ঠানকে স্বীকার করেন না। তাঁদের সাধনা একান্ত প্রেম-পিরীতি মার্গে গমন।
‘রাগানুগা’ বা ‘রাগাত্মিকা ভজন’ হোলো ভগবানের প্রতি ভক্তের প্রেমময় গাঢ় তৃষ্ণা বা গাঢ় অনুরাগ। এই গভীর প্রেমময় সাধনা বাউলমতে সহজিয়া রাগমার্গের ভজন।৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এইবার গুরুজী বৈষ্ণবশাস্ত্রে বর্ণিত ভক্তি-সাধনার বিভিন্ন ধারার কথা বলেছেন। এখানে একটা ব্যাপার আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, বাউলদের কথা বলতে গিয়ে বারবার বৈষ্ণবদের কথাও চলে আসছে। আমাদের জন্মভূমি নবদ্বীপ-কাটোয়ার(অর্থাৎ মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের লীলাভূমি) কাছাকাছি হওয়ায় আমরাও ছোটো থেকে কথায় কথায় শুনতাম –ওরা “বাউল-বৈষ্ণব” ! তার মানে বাউল ধারায় বৈষ্ণব ধারাটিরই অধিক প্রাধান্য রয়েছে – একথা বলাই যায়।
যাইহোক, আমরা এখন ফিরে আসি গুরুজীর কথায়। উনি ঐ যে বললেন – বৈষ্ণব সাধনার দুটি ধারার কথা, অর্থাৎ বৈধী সাধনা ও অবৈধী সাধনা। এই দুটির মধ্যে বৈধী সাধনা বা শাস্ত্রবিধানসম্মত যে সাধন-ভজনের ধারা – সেটির সাথেই আমরা পরিচিত। অপর যে ধারাটি রয়েছে অর্থাৎ অবৈধী সাধনা যা ভাবাশ্রিত বা রাগানুগা ভজন – এটির সাথে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বিশেষ পরিচয় নাই।
রাগানুগা ভজনকারী বা এই পদ্ধতির সাধনকারীদের মধ্যে আমরা বৈষ্ণবশাস্ত্রে বৃন্দাবনের গোপীদের কথার উল্লেখ পাই। তাছাড়া মীরাবাঈ-এর মতো কয়েকজন ভক্তি আন্দোলনের পথিকৃতের কথাও আমরা জানি, কিন্তু এঁদের নামের সাথে বাউলমতে সিদ্ধ বিভিন্ন সাধকদের (ভবা পাগলা, লালন সাঁই প্রমুখ) কথাও উল্লেখ করতে হয়। কারণ এঁরাও রাগানুগা ভজনের দ্বারাই সিদ্ধ হয়েছিলেন৷
যাইহোক, আমরা আবার গুরুমহারাজের করা আলোচনায় ফিরে যাই। এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – সেইজন্য বাউলগণ রাগানুগা ভক্তিকে নিজেদের সাধনার অনুকূল বলে ভাবেন। তাঁরা মনে করেন যুগলমিলনের দ্বারা সহজ মানুষের স্বরূপ জানা যাবে। আর রাগাত্মিকা ভজন দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের বোধে বোধ হয়।
দ্বিভূজ মুরলীধর নরাকার শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যে গাঢ় তৃষ্ণা – তাই হোলো বাউলমতে রাগ ৷৷
শ্রীকৃষ্ণ সত্তায় দুটি ভাব – একটি পূর্ণশক্তি অপরটি পূর্ণশক্তিমান, আশ্রয় এবং বিষয়, ভোগ এবং ভোক্তা। শক্তিমান নিস্তরঙ্গ (static) আর শক্তি তরঙ্গায়িত (dynamic)। নিস্তরঙ্গ স্বরূপশক্তির সঙ্গে তরঙ্গায়িত হ্লাদিনী শক্তির মিলনে বা একীকরণে যে মহাউল্লাস আবির্ভূত হয়__ তাই ‘মহাভাব’, আর সেইখানেই সহজ মানুষের অবস্থিতি।
এ মহাভাবে উপনীত হওয়া এবং সহজ মানুষের স্বরূপ সাক্ষাৎকার করাই হোলো বাউল সাধনার লক্ষ্য।৷
ভগবানের প্রতি গাঢ় তৃষ্ণারূপ যে তীব্র অনুরাগ, তাই ‘রাগ’। আর ওই রাগ-কে মানবভাবে আরোপ করে মানবিক পুরুষ এবং প্রকৃতিকে গভীর প্রেমে রূপান্তরিত করে থাকেন বাউল সাধকগণ।৷”
প্রিয় পাঠক – আমরা উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই বুঝলাম যে, বাউলগণ অবৈধী ভক্তি বা রাগানুগা ভজনকেই তাদের অনুকূল সাধনা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এইজন্যই সুশীল সমাজ, পণ্ডিত সমাজ, বাবুশ্রেণী অর্থাৎ যারা বেদ-বিধি মেনে শুদ্ধাচারে পূজাপাঠ-সাধন ভজন করেন – তাদের কাছে বাউলরা চিরদিনই ব্রাত্য থাকেন। যেহেতু সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বৈধী ভক্তির অনুকূলে সাধন করেন তাই বাউলগণ লোকসমাজ থেকে নিজেদেরকেও যেন একটু দূরে সরিয়ে রাখেন, নিজেরা একটু আলাদা থাকতেই ভালোবাসেন। তাঁরাও চান না তাঁদের এই অবৈধী-রাগানুগা ভজনকে নিয়ে তথাকথিত ভদ্র-সভ্য সমাজের বৈধী ভক্তি সাধনার সদস্যরা তাঁদেরকে বিব্রত করুক বা অন্যকিছু করুক !
বাউলদের রাগাত্মিকা ভক্তির সাধনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হোলো মহাভাবে উপনীত হওয়া এবং ‘সহজ মানুষ’-এর সাক্ষাৎকার। পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও পরমাপ্রকৃতি শ্রীরাধা বা শক্তিমান (dynamic) ও শক্তি (static)-র মিলনে বা যুগলমিলনের ফলে যে মহা রসোল্লাস হয় – সেখানেই ‘সহজ মানুষ’-এর অবস্থিতি। আর ‘রাগানুগা ভজন’-এর অর্থ হোলো পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গাঢ়-তৃষ্ণারূপ যে অনুরাগ বা মহাভাব অবস্থা – তাই ‘রাগ’। আর এই রাগ-কে অবলম্বন করে সাধনার দ্বারা মানবরূপী পুরুষ ও নারীর মধ্যে গভীর প্রেমের সঞ্চার সাধন করে – যুগলমিলনের মহাউল্লাস আস্বাদন করাই বাউল সাধনা।৷