শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুজীর লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের কথায় ছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছি – গুরুমহারাজ বাউলদের উভয় মতের সাধন (বৈধী এবং অবৈধী) পদ্ধতি, তাঁদের মধ্যেকার পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদ (নিচের Level-এ), তাঁদের (উভয়মতের) সাধনার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য – ইত্যাদি নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। এরপরে উনি এইসব বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন – আমরা এখন সেটাই দেখবো।
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – প্রকৃতি আশ্রয় (নারী নিয়ে সাধন) বাউল সাধনা_ একটি সুকঠিন সাধনা। এই সাধনার মধ্য দিয়ে বাউলগণ তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত চরম অবস্থায় উন্নীত হ’ন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – গরলের মধ্য হোতে অমৃতগ্রহণ বা ফণীর মস্তক হোতে মণি আরোহণের ন্যায়_ এটা অতি দুরূহ সাধনা। ইন্দ্রিয় উপভােগের পন্থা কোনো সাধনার ভিত্তিভূমি হোতে পারে না। তাঁদের সাধনা পুরুষ-প্রকৃতি মিলন-জনিত ইন্দ্রিয় উপভোগ নয়। নিয়মিত ইন্দ্রিয় সংযম করে ইন্দ্রিয়াদির ঊর্ধ্বে সহজস্থিতি লাভ। সুতরাং এটা উচ্ছৃঙ্খল ইন্দ্রিয়ভোগের আয়োজন নয় – বিন্দুধারণের জন্য দুর্লভ যোগসাধনা।
তাই বাউল-সাধনা ক্ষয়ের আয়োজন নয়, সঞ্চয়ের সাধনা – পূর্ণতালাভের সাধনা। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে যে, প্রকৃতি-আশ্রয় (নারী নিয়ে সাধন), বাউলদের সস্তা ইন্দ্রিয়ভোগের জন্য নয়। কামবিকৃত ব্যভিচারের জন্য প্রকৃতিসেবা নয় – এটা প্রাকৃত কামকে অতিক্রম করে ‘অপ্রাকৃত কামে’ অর্থাৎ ‘প্রেমে’ উত্তরণের জন্য। এই কারণে বাউলদের কাছে নারী হ্লাদিনী-স্বরূপিণী মহাশক্তি রসময়ী এবং প্রেমময়ী প্রকৃতি।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এই অংশে আমরা দেখতে পেলাম যে, গুরুমহারাজ প্রকৃতি আশ্রয়কারী বাউল-সাধকদের সাধনা সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। উনি যা বলেছেন, তার সারমর্ম হোলো – নারী নিয়ে সাধনকারীদের সাধনপন্থা খুবই দুরূহ ; যাকে উনি গরলের মধ্যে থেকে অমৃত গ্রহণের মতো অথবা বিষধর সর্পের মাথা থেকে মণি আরোহণের ন্যায় দূরূহ ! কিন্তু এই দূরূহ সাধনায় যাঁরা কৃতকার্য হ’ন, তাঁরা তাঁদের আকাঙ্খিত চরম অবস্থা অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের যুগল-মিলন তত্ত্বের বোধে বা মহাউল্লাসময় রসমাধুর্য্যের আস্বাদন করেন।
সুতরাং বাউলদের নারী নিয়ে সাধনা, সাধারণ মানুষের বিবাহিত জীবনে নারী-পুরুষের মিলনজনিত ইন্দ্রিয় উপভোগ নয়, নিয়মিত ইন্দ্রিয় সংযম দ্বারা ইন্দ্রিয়াদির ঊর্ধ্বে সহজ স্থিতিলাভ। নারী নিয়ে সাধনকারী বাউলগণের এই সাধনা হোলো – বিন্দুধারণের জন্য সুকঠিন দুর্লভ যোগ সাধনা। সেই অর্থে, এই পথের বাউলগণের প্রকৃতি-আশ্রয় (নারী নিয়ে সাধন)_ ইন্দ্রিয় ভোগের জন্য নয়, শক্তিক্ষয়ের আয়োজন নয় – শক্তি সঞ্চয়ের সাধনা, প্রাকৃত কাম-কে অতিক্রম করে অপ্রাকৃত কামে বা ‘প্রেমে’ উত্তরণের সাধনা। এইজন্যেই এই মত ও পথের বাউল সাধকগণ তার সাধন-সঙ্গিনীকে হ্লাদিনী-স্বরূপিনী মহাশক্তি রসময়ী এবং প্রেমময়ী প্রকৃতি রূপ সাক্ষাৎ শ্রীরাধা জ্ঞান করেন। যাইহোক, এবার আমরা গুরুমহারাজের কথা ধরে আরও এগিয়ে যাবো এবং দেখবো উনি আরো কি কি বলেছেন। এরপরে উনি বলেছেন – ” বাউলপ্রেম প্রকৃতি-পুরুষ মিলনাত্মক। এটা প্রাকৃতদেহ-উৎপন্ন আকর্ষণ হোতে আবির্ভূত হোলেও, এর পরিণতি কিন্তু দেহের ঊর্ধ্বগত এবং অপ্রাকৃত চিন্ময় আনন্দানুভূতিতে। প্রকৃতি-আশ্রয়ী সাধনা একান্ত মানবিক, মানবদেহের বাইরে কোনো সাধনা বাউলগণ স্বীকার করেন না। তাঁরা অনুমান ভজনে আস্থা রাখেন না। তাঁরা বর্তমান ভজনে আস্থাশীল। সেইজন্য স্থূল মানবদেহ তাঁদের নিকট অমূল্য সম্পদ। কারণ এই মানবদেহকে অবলম্বন করেই সহজ মানুষের স্বরূপ জানা যায়। প্রাকৃত কাম হতেই অপ্রাকৃত প্রেমের উদ্ভব, আর ঐ অপ্রাকৃত প্রেমে ‘সহজ মানুষ’ খেলেন।” প্রিয় পাঠক – প্রকৃতি-আশ্রয়কারী বাউল সাধকগণ অর্থাৎ বর্তমান ভজনে আস্থাশীল সাধকগণ_ প্রথমটায় প্রাকৃতদেহের আকর্ষণজনিত প্রকৃতি-পুরুষের মিলনাত্মক প্রেম দিয়ে শুরু করেন কিন্তু এর পরিণতি হয় অপ্রাকৃত চিন্ময় আনন্দানুভূতিতে। এই চিন্ময় আনন্দ-অনুভূতি বা সহজ মানুষের স্বরূপ জানা ইত্যাদি সবকিছুই সম্ভব হয় মানবদেহকে অবলম্বন করেই। কারণ মানবদেহ দিয়েই সাধনা হয়। প্রাকৃত কাম-ই বাউল সাধনার দ্বারা ধীরে ধীরে অপ্রাকৃত প্রেমে রূপান্তরিত হয়। আর সহজ মানুষের খেলা এই অপ্রাকৃত প্রেমে-ই।৷