শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র কথায় ছিলাম। আমরা এই গ্রন্থের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে, যেখানে গুরুমহারাজ ‘বর্তমান’ ভজনাকারী বাউল সাধকদের সাধনপথের কথা আলোচনা করছিলেন। আমরা এখন দেখবো – এরপরে গুরুমহারাজ এই বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন !
এরপর উনি বলেছেন – ” প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বিশ্বপ্রকৃতিতে মহিমময় ভগবানের (ঈশ্বরের) বিচিত্রলীলা সংঘটিত হোচ্ছে – সমগ্র জীবজগৎ এবং মানবের ভিতরেও ঐ একই ভগবৎলীলা সংঘটিত হয়ে চলেছে।
উদাস বাউলেরা ভগবৎপ্রেমে উন্মত্তবৎ, সর্বদা আত্মহারা–পাগলপারা। সহজমানুষ ভগবানের স্পর্শের জন্য তাঁরা বিহ্বল – ভগবৎপ্রেমে সর্বদা তন্ময়।
উদাস বাউলগণ বলেন, প্রেমানুরাগের পথ ধরে অগ্রসর হোতে হবে। তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রকৃতিভাব আরোপ করেন, অর্থাৎ নিজেদেরকে গোপী ভাবেন। এঁরা পরতত্ত্ব বা সহজ মানুষকে লাভ করবার জন্য আকুল হয়ে রাধাভাবে ভজনা করে পরকীয়া রস গ্রহণ করেন।
‘পরকীয়া’ তত্ত্বের অর্থ পরতত্ত্ব বা সহজ মানুষ – তাঁকেই সম্প্রদায় বিশেষে ভগবান, পরমাত্মা, পরমেশ্বর ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! কি সুন্দর কথা – চিরকালীন শাশ্বত সত্যকে গুরুমহারাজ কত সহজ করে এক লাইনেই বলে দিলেন – তাই না ! ‘এই বিশ্বপ্রকৃতিতে মহিমময় ঈশ্বরের যে লীলা ঘটে চলেছে, তা সমগ্র জীবজগতে– এমনকি সকল মানুষের ভিতরে ঘটাটাও তাই একান্তভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা। এই ঈশ্বরের লীলার সন্ধান পান উদাস বাউলেরা (সাধনার দ্বারা), আর তখন তাঁরা ভগবৎপ্রেমে উন্মাদবৎ, আত্মহারা, পাগলপারা হয়ে ‘সহজ মানুষ’ বা ভগবান অথবা পরমাত্মা, পরমেশ্বর (বিভিন্ন পরম্পরার সাধকগণ যে নামেই ডাকুক না কেন)-কে লাভ করার জন্য রাধাভাবে পরকীয়া সাধনা করে যান। কিন্তু ‘পরকীয়া’ কথাটির সঠিক অর্থ আমরা এই প্রথম জানলাম, কারণ আমরা আগে জানতাম স্ব-দারাকে অবহেলা করে পর-দারায় আসক্ত হওয়াকেই ‘পরকীয়া’ বলে ! কিন্তু আজ আমরা গুরুমহারাজের কাছে শিখলাম যে, ‘পরকীয়া’ শব্দের অর্থ “পরতত্ত্ব” – বাউলগণ যাকে বলেন “সহজ মানুষ”!
যাইহোক, এরপরে আমরা দেখবো এই বিষয়ে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন ! এরপরে উনি বলেছেন – “সাংসারিক নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ থেকেও মানব (বাউল সাধকগণ সংসার অতীত প্রেমময় ভগবানের জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করেন এবং ভগবানের পরশ পাবার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন। এই যে পরতত্ত্বে মতি, এটাই পরকীয়ার রতি বা পরকীয়া রস।৷
প্রেমের পথে – অনুরাগের পথে জীবন্ত ভাবের একান্ত প্রয়োজন | হ্লাদিনীস্বরূপিনী আনন্দময় প্রেমের নিত্যধারা সর্বদা প্রবহমান। সাধক ঐ ধারাতে সহজভাবে নিজেকে ছেড়ে দেবে অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করবে। ঐ নিত্যধারার সহিত নিজের জীবনধারার যোগ করতে হবে।৷
প্রিয় আত্মন্ – ঐ ধারাই মহতী ইচ্ছারূপে জগতে প্রবাহিত। ওই মহতী ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে নিরভিমানী হয়ে দৈন্য, আর্তি ও শরণাগত ভাব নিয়ে তাঁকে ভালবাসতে হবে। আর তখনই নিত্যধারার সঙ্গে সাধকের প্রেমানুরাগের ধারার একান্ত যোগ-মিলন সাধিত হবে এবং চিরকাঙ্খিত পরম প্রেমময় ভগবান বা সহজ মানুষের সাক্ষাৎ লাভ হবে। তখন দর্শন, স্পর্শন ও মিলন ঘটবে।৷”
পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ উপরোক্ত কথাগুলি শুধু যে বাউল সাধকদেরকে কেন্দ্র করে বলেছেন – তা নয়, ঐ কথাগুলি সকল মত বা পথের সাধকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাংসারিক নিয়মসমূহের মধ্যে থেকেও যাঁরা সংসারের ঊর্দ্ধে উঠে পরম প্রেমময় ভগবান বা ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন – তাঁর স্পর্শ্য পেতে আকুল হয়ে ওঠেন – তিনিই তো প্রকৃত সাধক ! গুরুমহারাজের কথায় সাধকের এই পরমতত্ত্বে বা পরতত্ত্বে মতিই হোলো ‘পরকীয়া’ !
ভক্তিভাবের যে সাধনা অর্থাৎ যেখানে অনুরাগ, যেখানে প্রেম – সেই সাধনার সাধকেরা বুঝতে পারেন যে, হ্লাদিনীস্বরূপিণী আনন্দময় প্রেমের নিত্যধারা সতত প্রবাহমান এবং তখন তাঁরা ঐ ধারাতে সহজভাবে নিজেকে ছেড়ে দেন অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করে দেন এবং মানবজীবনের অভীষ্টলাভ করেন।
এরপরে গুরুমহারাজ ঐ সাধনার ধারার আরো কিছু কথা বলেছেন। যেমন উনি বলেছেন – এই পথের সাধকদের ঐ নিত্যধারা বা পরমেশ্বরের মহতী ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে নিরভিমান, দৈন্য, আর্তি ও শরণাগত ভাব নিয়ে প্রেমময় ভগবানকে ভালবাসতে হয় – তবেই মহতী ইচ্ছার ধারার সাথে সাধকের ইচ্ছার যোগ-মিলন সাধিত হয়। আর এমনটা হোলে শুধুমাত্র সহজ মানুষ বা ভগবানের দর্শন মেলে তাই নয়,– তাঁকে স্পর্শ্য করা যায় এবং ভক্ত-ভগবানের মিলনও হয়, যাকে বৈষ্ণবগণ বলেন যুগল-মিলন।৷