শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের একেবারে শেষ ভাগের কথায় ছিলাম। ‘বর্তমান’ ধারার বাউল সাধকদের সাধনার কথা, সাধনপদ্ধতির কথা এবং সাধনার চূড়ান্ত অবস্থার কথা – আমরা এই অংশের আলোচনায় জানতে পেরেছিলাম। এরপর আমরা দেখবো এই পরিচ্ছেদের শেষভাগে এইসব সম্বন্ধে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” উদাস বাউলগণ আত্যন্তিক বিরহকাতর হয়ে গোপীভাবে–রাধাভাবে ভগবানের ভজনা করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতি-আশ্রিত ‘বর্তমান’ বাউলগণ মিলনাত্মক যোগসাধনা দ্বারা অপ্রাকৃত অধর মানুষ – লীলাময় ভগবানকে বোধে বোধ করেন। এঁরা বলেন – কৃষ্ণস্বরূপ পুরুষ এবং রাধাস্বরূপিণী প্রকৃতি নিত্যানন্দময় পরমতত্ত্বের প্রতিনিধি। এইজন্য পুরুষ ও প্রকৃতির মধ্যে অচ্ছেদ্য আকর্ষণ। এই মানবিক প্রেম যত গাঢ় হবে, ততোই রতিনিষ্ঠা সংঘটিত হতে থাকবে। তখন স্থূল সৃষ্টির মূল তত্ত্ব রজ-বীর্যের ধারা ঊর্ধ্বদিকে বইতে থাকবে। চরম অবস্থায় উভয় চেতনাশক্তি মিশে একীভূত হবে। ওই মিলন আত্মস্বরূপে সাম্যরসসংঘটিত হয়ে পরম আনন্দের আস্বাদন দান করবে।”
প্রিয় পাঠক ! এর আগে গুরুমহারাজ উদাস বাউলদের সাধনার কথা বলেছিলেন – এবার এখানে গুরুমহারাজ ‘বর্তমান’ মতের প্রকৃতি আশ্রয়কারী সাধকদের সাধনা এবং তাঁদের সাধনার চূড়ান্ত অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। উনি বলেছেন – “প্রকৃতি (নারী) আশ্রিত ‘বর্তমান’ মতের বাউল সাধকগণ মিলনাত্মক (নর-নারীর মিলন) যোগসাধনা দ্বারা অপ্রাকৃত ‘অধর মানুষ’ বা লীলাময় ভগবানের বোধ করেন। এই মতে – প্রতিটি পুরুষ-ই কৃষ্ণ এবং প্রতিটি নারী-ই রাধা এবং এঁরাই হোলো নিত্যানন্দময় পরমতত্ত্বের প্রতিনিধি। এছাড়া উনি আরও বললেন যে, নারী-পুরুষের মধ্যে যে চিরকালীন অচ্ছেদ্য আকর্ষণ – তার কারণও ওটাই।
বাউলগণ বলেন – নরনারীর পরস্পরের প্রতি ঐ যে অমোঘ আকর্ষণ, এই আকর্ষণ বা পরস্পরের প্রতি প্রেম-ভালবাসা যত প্রগাঢ় হোতে থাকবে, ততই ‘রতিনিষ্ঠা’ সংঘটিত হোতে থাকবে। এই রতিনিষ্ঠা ব্যাপারটি কি? – এটা তো আমরা সাধারণ মানুষেরা ঠিক বুঝিনা, তাই গুরুমহারাজ নিজেই আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। উনি বলেছেন – সাধক-সাধিকার মধ্যে প্রেমের গাঢ় অবস্থায় তাদের মধ্যে যে মিলন হয়, সেই মিলনে স্থূল সৃষ্টির যে মূল তত্ত্ব অর্থাৎ রজ-বীর্যের যে নিম্নগামী ধারা (যার ফলে সন্তান উৎপাদন হয়), তা ঊর্ধ্বগামী হয়ে যায় ! এ এক অদ্ভুত ও অত্যাশ্চর্য্য রহস্য !
এই মানবশরীরকে কেন্দ্র করে কত লীলাই যে ঘটে যেতে পারে – তার সীমা-পরিসীমা করা দুষ্কর। তবে এখানে শর্ত একটাই – নিষ্ঠাভরে সাধনভজন করে যেতে হবে, তবেই লীলাময়ের লীলা এই শরীর দিয়েই অনুভূত হবে। যাঁর এই অবস্থা লাভ হয়েছে, তিনি তখন একান্তভাবে চান – সমস্ত মানুষই সাধনার দ্বারা ঐ বোধে উপনীত হোক। তাইতো তাঁরা সকল মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন – “এমন মানব-জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।”– অর্থাৎ মানবদেহকে কর্ষণ করলে বা নিষ্ঠাভরে সাধন-ভজন করলে লীলাময়ের লীলা অনুভূত হয়। যেমন গুরুমহারাজ এখানে বললেন বাউল সাধকদের মিলনাত্মক সাধনের চূড়ান্ত অবস্থায় অর্থাৎ রজ-বীর্য্যের ধারা যখন ঊর্ধ্ব দিকে বইতে থাকে – তখন উভয়ের চেতনাশক্তি একীভূত হয়ে যায় এবং আত্মস্বরূপে সাম্যরস সংঘটিত হয়ে পরম আনন্দের আস্বাদন হয়। মানবজীবনের এ এক পরম প্রাপ্তি – যা বাউল সাধনার চূড়ান্ত অবস্থা।
যাই হোক, আমরা এখন চলে যাবো এর পরের অংশে। দ্যাখা যাক্ সেখানে গুরুমহারাজ এই বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন ! এর পরে উনি বলেছেন – ” প্রেমের অবস্থা যতই গভীর হবে, সাধক ততই বাহ্যচেতনাহীন অবস্থা লাভ করবে। বাহ্যচেতনা ক্রমশঃ যখন লুপ্ত হয়ে যাবে, তখন আর দেহগত কোনো আকর্ষণ থাকবে না অর্থাৎ প্রাকৃত কামচেতনা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই অবস্থাকে বাউলেরা “জ্যান্তে মরা” বলে। এটা নিরভিমানিক পূর্ণ প্রেমের অবস্থা ! এই অবস্থায় দেশ-কাল-পাত্রের কোনো বন্ধন থাকে না। এই অবস্থাতে মনের মানুষ বা সহজ মানুষের বোধে-বোধ (বোধ) হয়।
প্রকৃতি-আশ্রিত বর্তমান বাউলগণ যে সাধনার পদ্ধতি গ্রহণ করেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হোলো যথাক্রমে – কামবীজ-কামগায়ত্রী জপ, যুগলমূর্তি ধ্যান, মদনানুভূতিকে উত্তেজিত করে যোগ পদ্ধতি দ্বারা ঐ অনুভূতিকে সুষুম্নাপথে ঊর্ধ্বগামী করা এবং ক্রমশঃ আজ্ঞাচক্রে দ্বিদল পদ্মে উন্নীত করা ! প্রত্যেক মানবদেহের মধ্যে যে পিতৃশক্তি ও মাতৃশক্তি বিদ্যমান রয়েছে – সুষুম্মার মধ্য দিয়ে ঐ শক্তিকে দ্বিদল পদ্মে উন্নীত করলে উভয়শক্তির মিলনজাত চরম অবস্থা উপস্থিত হয়, তখন আত্মস্বরূপে অর্থাৎ অন্তর-আত্মায় ঐ পরমতত্ত্বের বোধে-বোধ (বোধ) হয় এবং তাই পরমানন্দ সহজস্থিতি বা মনের মানুষের অপরোক্ষ অনুভূতি !”