শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরামানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্তে লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র সপ্তম পরিচ্ছেদের প্রথম অংশে ছিলাম। এই অংশে গুরুমহারাজ সহজিয়া ‘বর্তমান’ মতের সাধকদের সাধন রহস্য নিয়ে কথা বলছিলেন। এখন আমরা দেখবো গুরুমহারাজ এরপরে আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে উনি বর্তমান মতের বাউল সাধনার রহস্য সম্বন্ধে যা বলেছেন, তা হোলো – ” রূপের অভ্যন্তরে স্বরূপ রয়েছে এবং স্বরূপের প্রকাশ রূপের ভিতর দিয়ে। সেইহেতু রূপ ও স্বরূপ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই বর্হিরূপেতেই স্বরূপ বিরাজমান। আর স্বরূপের ভিতরেই ‘রসের মানুষ’ বা ‘সহজ মানুষে’র অবস্থিতি। রাগের পথে – প্রেমের পথে তার অনুসন্ধানে যেতে হবে অর্থাৎ উজান বইতে হবে।
রূপের সাধনা ব্যতীত স্বরূপের স্থিতি হবে না এবং স্বরূপে স্থিতি লাভ না হোলে ‘রাগের মানুষ’ রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ-লাভ হয় না।
সুতরাং রূপ-কে অর্থাৎ প্রাকৃত দেহকে প্রথমে আশ্রয় করে অপ্রাকৃত স্বরূপে পৌঁছাতে হবে এবং সেখানেই শৃঙ্গারঘন রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। এখন তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে যে, মানবদেহরূপ ভান্ডে স্বরূপ আছে, আর সেই স্বরূপতত্ত্বের ভিতর পরমতত্ত্ব – রসের মানুষ – সহজ মানুষ – শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান রয়েছেন,– এই হোলো বাউলদের “ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড” তত্ত্ব।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! বাউলগণ মানবদেহকে খুবই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আর শুধু বাউলগণই বা কেন – যে কোনো আধ্যাত্মিক পরম্পরার সাধকেরাই জানেন যে, এই মানবদেহখানিই হোলো স্বর্ণখনি। একে কর্ষণ করতে পারলেই সেই স্বর্ণখনির সন্ধান পাওয়া যায় – না হোলে শুধুই আসা আর যাওয়া, মাঝখানে কিছুদিন কচকচানি এবং সুখ-দুঃখের গাওনা গাওয়া। গুরুমহারাজও বাউল মতের সেই কথাই বলেছেন যে, ‘রূপের (দেহের) মধ্যেই স্বরূপ রয়েছে, আর স্বরূপের ভিতর রয়েছে ‘রসের মানুষ’ বা ‘সহজ মানুষ’– যার সন্ধান পাওয়াই বাউল সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। সেইজন্যেই বাউলগণের “রূপে”-র সাধনা ! বাউলগণ যে সুন্দর করে ঝুঁটি বাঁধেন, রসকলি পড়েন, সুন্দর সুন্দর পোশাক পড়েন – অর্থাৎ এককথায় সুন্দর করে সাজেন,– তাও রূপ সাধনারই অঙ্গ। আর সর্বোপরি অন্তরের রূপ-সৌন্দর্যকে সাধনার দ্বারা (উজান পথে বেয়ে অর্থাৎ কুলকুণ্ডলীনীকে জাগিয়ে ঊর্ধ্বপথে চালনা করতে হবে) বিকশিত করা – এটাই প্রকৃত সাধনা ! প্রকৃতপক্ষে যে কোনো সাধকের অন্তঃরূপ বিকশিত হোলে বর্হিরূপেও তার প্রভাব পড়ে। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি – যে গৃহের বা আশ্রমের ঠাকুরঘরে নিষ্ঠাভরে পূজা-পাঠ হয়, ধ্যান-জপ হয়, সাধন-ভজন হয় –সেখানে যেমন ঐ সাধকের মধ্যে একটা ‘রূপে’-র ঝলকানি ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনি সেখানকার ঠাকুরের ফটো বা মূর্ত্তির মধ্যেও একটা ঔজ্জ্বল্য বা ঝলমলে ভাব ফুটে ওঠে ৷ এই ব্যাপারটা আপনারাও মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন !
যাইহোক, যা বোঝা গেল_ বাউলমতে রূপের সাধন করার একমাত্র উদ্দেশ্য হোলো–’রূপ’-কে আশ্রয় করে স্বরূপে উন্নীত হওয়া। কারণ সেখানে স্থিতিলাভ করতে পারলেই শৃঙ্গারঘন রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ (মনের মানুষ, সহজ মানুষ, রাগের মানুষ)-এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গুরুমহারাজ পরিষ্কার করে এক লাইনে পুরো রহস্যটা বলেছেন এইভাবে যে, ‘আগে দেহতত্ত্ব জানতে হবে (অর্থাৎ রূপের সাধনা করতে হবে), কারণ দেহ-ভান্ডেই স্বরূপতত্ত্ব রয়েছে, আর স্বরূপতত্ত্বের ভিতরে পরমতত্ত্ব অর্থাৎ রসের মানুষ, সহজ মানুষ, রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান। এটাই বাউলগণের “ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড” তত্ত্ব ! আমরা এখন দেখবো এরপরে গুরুমহারাজ বাউল সাধনা বিষয়ে আরও কি কি বলেছেন ! এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রাকৃত দেহকে আশ্রয় করে দেহাতীত পরমতত্ত্ব তথা আত্মতত্ত্বের বোধে-বোধই বাউলদের সাধনা, অর্থাৎ স্থূল হোতে সূক্ষ্মে অগ্রসর হয়ে অবশেষে স্বরূপেই পরমতত্ত্বের সাক্ষাৎ লাভ হবে। তন্ত্রের ভাষায় এটাই ষটচক্র ভেদ, যোগমতে যোগাভ্যাস (যোগসাধনা), বেদান্তের মতে পঞ্চকোষ বিবেকভেদ, আর বাউলদের উজান বাওয়া – মুখ্যতঃ একই পথের প্রকারভেদ। এই বাউলরা সংসার সাগরে দেহভান্ডে মন পবনের উজান বাইছে – রূপ ধরে অরূপে পৌঁছে অপরূপের বোধে-বোধের জন্য।” প্রিয় পাঠক ! দেখলেন তো ব্যাপারটা গুরু মহারাজ কেমন সুন্দর করে বোঝালেন!! এই যে এবার যুগপুরুষরূপে অবতীর্ণ হয়ে স্বামী পরামানন্দ আমাদের মনে স্থায়ী হয়ে বসে থাকা একটা ভুল ভেঙে দিলেন, উনি বললেন – ‘যত মত – তত পথ’ কথাটা ভুল ভাবে প্রয়োগ হয়েছে –” মত ভিন্ন ভিন্ন হোলেও ‘পথ’ সেই একটাই ! আর সেই পথ হোলো সুষুম্না মার্গ বা মধ্যম পথ (বৌদ্ধমতে মজঝিম্ পথ)। যেকোনো মতাবলম্বী সাধকই হোক না কেন – চূড়ান্ত অবস্থায় বা পরম লক্ষ্যে পৌঁছাতে হোলে কুলকুণ্ডলীনী জাগ্রত করে, তাকে উজান পথে (ঊর্ধ্বগামী করে) নিয়ে গিয়ে – একে একে ষটচক্রের এক একটি করে পদ্ম ভেদ করতে করতে আজ্ঞাচক্রে উপনীত হোতে হবে। জীবের চেতনা এখানে পৌঁছে স্থিত হোতে পারলেই জীব “শিব” হয়, এখানেই ভক্ত-ভগবানের সাক্ষাৎ পায় (মিলন হয় সহস্রারে)।৷
এইজন্যেই গুরুমহারাজ ভারতবর্ষের প্রাচীন কয়েকটি সাধনমার্গের চূড়ান্ত অবস্থা যে একই – সেই কথাই বলেছেন। উনি বলেছেন, বাউলমতের রূপের সাধনার দ্বারা (বা উজান বাওয়া) স্বরূপস্থিতি প্রাপ্ত হয়ে রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ লাভই হোলো যোগসাধনার যোগাভ্যাসের দ্বারা আত্মা-পরমাত্মার অভেদ তত্ত্বের বোধ, বেদান্ত সাধনা অর্থাৎ জ্ঞানমার্গীদের কাছে এই স্থিতিলাভই হোলো ‘পঞ্চকোষঃ বিবেকভেদাঃ’ !!