শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা* -র সপ্তম পরিচ্ছেদের আলোচনায় ছিলাম_যেখানে উনি বাউলদের সাধনতত্ত্ব নিয়ে এবং ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব নিয়ে কথা বলছিলেন। আমরা এবার দেখবো এই বিষয়ে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন।
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” বাউলগণ দেহাতীত আত্মাকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করে থাকেন। যথা – মানুষ, মনের মানুষ, অধর মানুষ, সহজ মানুষ, রসের মানুষ, সোনার মানুষ, ভাবের মানুষ, অচিন মানুষ, আলেখ নিরঞ্জন, সাঁই প্রভৃতি। আর বাউল সাধনাও ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লিখিত হয়ে থাকে ; যেমন – সহজ ভজন, রসিক ভজন, মানুষ ভজন, রাগের ভজন, যুগল ভজন, ভাবের ভজন – ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রকৃতি হয়ে অর্থাৎ প্রকৃতিভাব আশ্রয় করে পরমতত্ত্ব বোধ করতে হবে। আর মধুরভাবের মধ্যেই প্রকৃতির পরমসত্তা নিহিত থাকায় সহজ সাধককে মধুরভাব অবলম্বন করতে হবে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! ভারতীয় শাস্ত্র মানব সংক্রান্ত আলোচনায় সবসময়েই দুটো শব্দ ব্যবহার করে – ‘দেহ` এবং ‘দেহী’। দেহকে কেন্দ্র করেই ‘দেহী’ বা দেহাতীত আত্মা-র অবস্থান। দেহকে কাজে লাগিয়ে সেই দেহাতীত আত্মাকে প্রাপ্ত হওয়ার জন্যই সাধনা। বাউলগণ তাদের সাধনাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন, যেমন – সহজ ভজন, রসিক ভজন, মানুষ ভজন, যুগল ভজন ইত্যাদি এবং দেহাতীত আত্মাকেও তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকেন, যেমন – মানুষ, মনের মানুষ, অধর মানুষ, সহজ মানুষ, ইত্যাদি। তাছাড়া বাউল সাধনার অন্যতম অঙ্গ নিজে প্রকৃতি হয়ে বা প্রকৃতি (নারী)ভাব গ্রহণ করে সাধনা করতে হয় এবং সেই সাধনার দ্বারা পরমতত্ত্বের বোধ করতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র প্রকৃতিভাব অবলম্বন করলেই হবে না – হ্লাদিনী-স্বরূপিনী পরমা প্রকৃতি রাধাভাব বা মধুরভাব অবলম্বন করে অগ্রসর (সাধন পথে) হোতে হবে – তবেই পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে।
যাই হোক, এরপর আমরা দেখবো মধুর ভাবের বিষয়ে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে উনি বলেছেন – ” এই মধুরভাব শ্রেণীভেদে তথা রতিভেদে তিন প্রকার, যথা – সমর্থা, সমঞ্জসা এবং সাধারণী। সাধারণী রতিতে দেহমিলনাকাঙ্ক্ষাই প্রবল থাকে এবং আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা প্রবল, তাই একে ‘সহজ প্রীতি’-ও বলা হয়। এটা নিছক কাম প্রচেষ্টা মাত্র; বলা যেতে পারে দেহ-সম্ভোগ ইচ্ছা হোতে উদ্ভব হয় এই সাধারণ রতির।৷ কুঞ্জার প্রেম (শ্রীকৃষ্ণলীলায় উল্লেখিত) সাধারণী রতির দৃষ্টান্ত।
সমঞ্জসা রতিতে অধিক পরিমাণে ভগবৎ-প্রীতি বিদ্যমান, কিন্তু স্বাভিমানযুক্ত পুরুষকার বর্তমান থাকে। আর স্বাভিমানবশতঃ কিঞ্চিৎ সম্ভোগ-ইচ্ছা বর্তমান থাকে। সেইজন্য এটা গুণজ প্রীতি। এখানেও সম্পূর্ণভাবে পুরুষভাব বর্জিত হয়নি অর্থাৎ প্রকৃতিভাবে পূর্ণতা আসেনি। রুক্মিণী, সত্যভামাদি শ্রীকৃষ্ণ-মহিষীগণ এই সমঞ্জসা রতির দৃষ্টান্ত।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এখানে একটা কথা খুবই খেয়াল রাখতে হবে যে, ‘রস’ আর ‘রতি’-র মধ্যে গুলিয়ে ফেললে হবে না। সকল জীবসহ সাধারণ মানুষদের যে ভোগ-বাসনা, মিলনেচ্ছা বা সম্ভোগ-ইচ্ছা এগুলি শুধুমাত্র ‘রস’ অবস্থা থেকে__সেগুলি ‘রতি’ অবস্থার মিলনেচ্ছা নয় ! কারণ, গুরুমহারাজ আগেই বলে দিয়েছেন যে, ‘রস’ গাঢ় হোলে (সাধনার দ্বারা) ‘রতি’-র প্রকাশ ঘটে। এককথায় বলতে গেলে কৃষ্ণপদে (ঈশ্বরে) মতি-ই ‘রতি’ ! সুতরাং সেইজন্যই সাধারণী রতি-তে যে আত্মসুখের ইচ্ছা প্রবল – সেটাও শ্রীকৃষ্ণ (ঈশ্বর, ভগবান)-কে কেন্দ্র করে ! তাই সাধারণী রতির উদাহরণ হোলো শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রণয়াসক্তা নারী কুব্জা, যিনি প্রথম জীবনে কুৎসিত দর্শন কুঁজ-বিশিষ্ট নারী হয়েও পরে শ্রীকৃষ্ণের কৃপালাভ করে অসাধারণ সুন্দরী নারীতে পরিণত হ’ন এবং শ্রীকৃষ্ণ মহিষী হ’ন। এই প্রীতি সঙ্গজ প্রীতি।৷
এইভাবে সমঞ্জসা রতির নায়িকারা (সাধকেরা) আরও একটু উন্নত অর্থাৎ এখানে রস আরো গাঢ় হয়েছে। গুরুমহারাজ বলেছেন – ‘এই ভাবেও স্বাভিমানযুক্ত পুরুষভাব থাকে।’ গুরুজীর এই কথাতেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে সমঞ্জসা রতির নায়িকা বলতে সাধক(নারী ও পুরুষ উভয়কে)-দেরকেই বোঝানো হয়েছে। যে কোনো মানুষের (নারী ও পুরুষ) মধ্যে যে স্বাভিমান বা পুরুষকার – তাই পুরুষভাব ! যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ প্রাপ্তিতে (চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া) সম্পূর্ণরূপে ‘প্রকৃতিভাব’ অবলম্বন করা প্রয়োজন – তাই সমঞ্জসা রতির দ্বারাও সাধক পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। শ্রীকৃষ্ণ মহিষীগণ এর উদাহরণ। এই প্রীতি গুণজ প্রীতি।
সাধকের পূর্ণতা আসে সমর্থা রতির দ্বারা ! এটাই ঠিক ঠিক ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা’ অবস্থা ! বৈষ্ণব কবি বলেছেন, “তোমারি কুশলে কুশল মানি।” এই রতিতে নিজ ভোগ-সুখেচ্ছা একদমই থাকে না। এই প্রীতিই নৈসর্গিক প্রীতি। ব্রজগোপীগণ অর্থাৎ যাঁরা গোপনে গোবিন্দ ভজনা করেন – তাঁরাই এই রতির উদাহরণ !
এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” বাউলগণ দেহাতীত আত্মাকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করে থাকেন। যথা – মানুষ, মনের মানুষ, অধর মানুষ, সহজ মানুষ, রসের মানুষ, সোনার মানুষ, ভাবের মানুষ, অচিন মানুষ, আলেখ নিরঞ্জন, সাঁই প্রভৃতি। আর বাউল সাধনাও ভিন্ন ভিন্ন নামে উল্লিখিত হয়ে থাকে ; যেমন – সহজ ভজন, রসিক ভজন, মানুষ ভজন, রাগের ভজন, যুগল ভজন, ভাবের ভজন – ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রকৃতি হয়ে অর্থাৎ প্রকৃতিভাব আশ্রয় করে পরমতত্ত্ব বোধ করতে হবে। আর মধুরভাবের মধ্যেই প্রকৃতির পরমসত্তা নিহিত থাকায় সহজ সাধককে মধুরভাব অবলম্বন করতে হবে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! ভারতীয় শাস্ত্র মানব সংক্রান্ত আলোচনায় সবসময়েই দুটো শব্দ ব্যবহার করে – ‘দেহ` এবং ‘দেহী’। দেহকে কেন্দ্র করেই ‘দেহী’ বা দেহাতীত আত্মা-র অবস্থান। দেহকে কাজে লাগিয়ে সেই দেহাতীত আত্মাকে প্রাপ্ত হওয়ার জন্যই সাধনা। বাউলগণ তাদের সাধনাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন, যেমন – সহজ ভজন, রসিক ভজন, মানুষ ভজন, যুগল ভজন ইত্যাদি এবং দেহাতীত আত্মাকেও তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকেন, যেমন – মানুষ, মনের মানুষ, অধর মানুষ, সহজ মানুষ, ইত্যাদি। তাছাড়া বাউল সাধনার অন্যতম অঙ্গ নিজে প্রকৃতি হয়ে বা প্রকৃতি (নারী)ভাব গ্রহণ করে সাধনা করতে হয় এবং সেই সাধনার দ্বারা পরমতত্ত্বের বোধ করতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র প্রকৃতিভাব অবলম্বন করলেই হবে না – হ্লাদিনী-স্বরূপিনী পরমা প্রকৃতি রাধাভাব বা মধুরভাব অবলম্বন করে অগ্রসর (সাধন পথে) হোতে হবে – তবেই পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে।
যাই হোক, এরপর আমরা দেখবো মধুর ভাবের বিষয়ে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে উনি বলেছেন – ” এই মধুরভাব শ্রেণীভেদে তথা রতিভেদে তিন প্রকার, যথা – সমর্থা, সমঞ্জসা এবং সাধারণী। সাধারণী রতিতে দেহমিলনাকাঙ্ক্ষাই প্রবল থাকে এবং আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা প্রবল, তাই একে ‘সহজ প্রীতি’-ও বলা হয়। এটা নিছক কাম প্রচেষ্টা মাত্র; বলা যেতে পারে দেহ-সম্ভোগ ইচ্ছা হোতে উদ্ভব হয় এই সাধারণ রতির।৷ কুঞ্জার প্রেম (শ্রীকৃষ্ণলীলায় উল্লেখিত) সাধারণী রতির দৃষ্টান্ত।
সমঞ্জসা রতিতে অধিক পরিমাণে ভগবৎ-প্রীতি বিদ্যমান, কিন্তু স্বাভিমানযুক্ত পুরুষকার বর্তমান থাকে। আর স্বাভিমানবশতঃ কিঞ্চিৎ সম্ভোগ-ইচ্ছা বর্তমান থাকে। সেইজন্য এটা গুণজ প্রীতি। এখানেও সম্পূর্ণভাবে পুরুষভাব বর্জিত হয়নি অর্থাৎ প্রকৃতিভাবে পূর্ণতা আসেনি। রুক্মিণী, সত্যভামাদি শ্রীকৃষ্ণ-মহিষীগণ এই সমঞ্জসা রতির দৃষ্টান্ত।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! এখানে একটা কথা খুবই খেয়াল রাখতে হবে যে, ‘রস’ আর ‘রতি’-র মধ্যে গুলিয়ে ফেললে হবে না। সকল জীবসহ সাধারণ মানুষদের যে ভোগ-বাসনা, মিলনেচ্ছা বা সম্ভোগ-ইচ্ছা এগুলি শুধুমাত্র ‘রস’ অবস্থা থেকে__সেগুলি ‘রতি’ অবস্থার মিলনেচ্ছা নয় ! কারণ, গুরুমহারাজ আগেই বলে দিয়েছেন যে, ‘রস’ গাঢ় হোলে (সাধনার দ্বারা) ‘রতি’-র প্রকাশ ঘটে। এককথায় বলতে গেলে কৃষ্ণপদে (ঈশ্বরে) মতি-ই ‘রতি’ ! সুতরাং সেইজন্যই সাধারণী রতি-তে যে আত্মসুখের ইচ্ছা প্রবল – সেটাও শ্রীকৃষ্ণ (ঈশ্বর, ভগবান)-কে কেন্দ্র করে ! তাই সাধারণী রতির উদাহরণ হোলো শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রণয়াসক্তা নারী কুব্জা, যিনি প্রথম জীবনে কুৎসিত দর্শন কুঁজ-বিশিষ্ট নারী হয়েও পরে শ্রীকৃষ্ণের কৃপালাভ করে অসাধারণ সুন্দরী নারীতে পরিণত হ’ন এবং শ্রীকৃষ্ণ মহিষী হ’ন। এই প্রীতি সঙ্গজ প্রীতি।৷
এইভাবে সমঞ্জসা রতির নায়িকারা (সাধকেরা) আরও একটু উন্নত অর্থাৎ এখানে রস আরো গাঢ় হয়েছে। গুরুমহারাজ বলেছেন – ‘এই ভাবেও স্বাভিমানযুক্ত পুরুষভাব থাকে।’ গুরুজীর এই কথাতেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে সমঞ্জসা রতির নায়িকা বলতে সাধক(নারী ও পুরুষ উভয়কে)-দেরকেই বোঝানো হয়েছে। যে কোনো মানুষের (নারী ও পুরুষ) মধ্যে যে স্বাভিমান বা পুরুষকার – তাই পুরুষভাব ! যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ প্রাপ্তিতে (চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া) সম্পূর্ণরূপে ‘প্রকৃতিভাব’ অবলম্বন করা প্রয়োজন – তাই সমঞ্জসা রতির দ্বারাও সাধক পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। শ্রীকৃষ্ণ মহিষীগণ এর উদাহরণ। এই প্রীতি গুণজ প্রীতি।
সাধকের পূর্ণতা আসে সমর্থা রতির দ্বারা ! এটাই ঠিক ঠিক ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা’ অবস্থা ! বৈষ্ণব কবি বলেছেন, “তোমারি কুশলে কুশল মানি।” এই রতিতে নিজ ভোগ-সুখেচ্ছা একদমই থাকে না। এই প্রীতিই নৈসর্গিক প্রীতি। ব্রজগোপীগণ অর্থাৎ যাঁরা গোপনে গোবিন্দ ভজনা করেন – তাঁরাই এই রতির উদাহরণ !