শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত)এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা গুরুমহারাজের শ্রীহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ “বাউলের মর্মকথা”-র সপ্তম পরিচ্ছেদের কথায় ছিলাম ৷ এই অধ্যায়ে উনি বাউল সাধনার বিভিন্ন ক্রম আলোচনা করতে করতে তিনপ্রকার রতির বিশ্লেষণ করে বোঝাচ্ছিলেন যে, সমর্থা রতিই বাউল (বৈষ্ণব) সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ৷ এছাড়া উনি মানুষতত্ত্বেরও ব্যাখ্যা করেছেন ৷ আমরা এখন দেখবো এরপরে গুরুমহারাজ ঐ সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন ৷
এরপরে উনি বলেছেন – ” যাঁরা জিতেন্দ্রিয় ন’ন অর্থাৎ যাদের আধার উন্নত নয় এবং উক্ত লক্ষণযুক্ত উত্তম প্রকৃতি লাভ করেন নি_ তাঁদের সহজিয়া বাউলসাধনায় প্রবেশাধিকার নাই ৷ কারণ অনধিকারীগণের পতন অনিবার্য্য ৷ বাউলগণ বলেন সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়জয়-সিদ্ধ হোলে তবেই রসসাধনায় প্রবেশাধিকার লাভ হয় ৷ নতুবা অঘটন ঘটবে — নিশ্চই জানবে ৷ তাঁরা বলেন – সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবগণ এই সাধনার বিষয়চর্চা না করে ভালোই করেছেন ৷ কারণ এটা ব্যাপকভাবে প্রচার করার বিষয় নয় ৷ এটা অতি দুর্লভ এবং একমাত্র উত্তমাধিকারীগণ ভিন্ন অন্য কারো এই আচারে অধিকার নাই ৷”
প্রিয় পাঠক — সাধন-ভজন করার অধিকার এবং প্রয়োজন সকল মানুষেরই রয়েছে, কিন্তু বাউল সাধনায় (বিশেষত: নারী নিয়ে সাধনের ক্ষেত্রে) সকল মানবের অধিকার নাই ৷ শুধুমাত্র উন্নত (আধ্যাত্মিকভাবে) মানবদেরই অধিকার রয়েছে এই সাধনার ৷ কারণ, সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়লিপ্সা মুক্ত হয়েছেন যিনি, যিনি সাধনার দ্বারা তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহকে জয় করেছেন একমাত্র তিনিই বাউলসাধনা বা রসসাধনায় প্রবেশাধিকার লাভ করেন আর অনধিকারীরা এই সাধনায় এলে — তাঁদের পতন অনিবার্য্য ৷ এখানে ‘পতন’ অর্থে সাধন-ভজন করে খানিকটা অগ্রসর হয়ে থাকলেও যাদের সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়-সংযম হয়নি, তারা এই সাধনায় সিদ্ধ হোতে তো পারেই না বরং সাধনসিদ্ধি হারিয়ে তারা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের ন্যায় হয়ে যায় ৷৷ যাইহোক, এই আলোচনায় গুরুমহারাজ আর একটি দিকের কথাও তুলে ধরেছেন – আর সেটা হোলো — বৈষ্ণবগণের মধ্যে যারা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, তারা বাউলসাধনার সমালোচনা করেন, এই মতের বিরোধিতা করেন এবং অন্যদেরকেও এই মতে সাধনবিমুখী হোতে সাহায্য করেন ৷ কিন্তু বাউলসাধকগণ এই ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন ৷ তাঁরা বলেন যে, ঐ সব সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বৈষ্ণবগণ এই সাধনা (রসসাধনা)-কে গ্রহণ না করে ভালোই করেছে ৷ কারণ এর ফলে দূর্লভ বাউলসাধনার গোপনীয়তা অনেকটাই রক্ষা পেয়েছে ৷ এটি ব্যাপকভাবে প্রচার পাবার বিষয়ও নয় ৷ আর এই সাধনা দূর্লভ বলেই এটি উত্তম অধিকারী ছাড়া অন্যকারোর এতে অধিকার নাই ৷৷ যাইহোক এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ বাউলমতের সাধনার পথে তিনটি অবস্থাভেদ আছে ; যথা প্রবর্ত্ত, সাধক এবং সিদ্ধ ৷ সহজিয়া সাধনার পথে বাউলগণকে ঐ অবস্থাগুলি অবগত হয়ে অতিক্রম করতে হয় ৷
প্রবর্ত্ত অবস্থা :- শ্রদ্ধা এবং দাস্যভাব ও দুটি আশ্রয় – নাম ও মন্ত্র ৷ শ্রী সদ্গুরুর চরণযুগল আশ্রয় করে নাম গ্রহণ করতে হয় এবং অপরাধশূন্য চিত্তে নাম-নামী অভেদজ্ঞানে ভাবনা করতে হয় ৷ শৌচ, তীর্থবাস, ইন্দ্রিয়য়সংযম ইত্যাদি এর অঙ্গ। এই অবস্থায় ব্যাকুল হয়ে মন্ত্রপ্রাপ্তির জন্য সদ্গুরুর শরণাপন্ন হতে হয় ৷ নামে রুচি না হোলে মন্ত্রপ্রাপ্তি হয় না ৷ নামে রুচি হোলে চিত্তের কলুষ নাশ হয়, দেহ শুদ্ধ হয় ৷ চিত্তশুদ্ধিতে দেহে সাত্ত্বিক ভাব উৎপন্ন হয় ৷ তখন সদ্গুরু বা ঈশ্বর প্রসন্ন হ’ন,(ফলে) দীক্ষামন্ত্র প্রাপ্তি ঘটে ৷ মন্ত্রসিদ্ধি হোলে ‘প্রবর্ত্তে’র ‘সাধক’ অবস্থায় উত্তরণ ঘটে ৷
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! বাউল সাধনায় বাউলদের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা (প্রবর্ত্ত, সাধক ও সিদ্ধ)-র কথা এখানে আলোচনা করেছিলেন ৷ আমরা আজকের এপিসোডে শুধুমাত্র ‘প্রবর্ত্ত’ অবস্থার সাধকদের সম্বন্ধে গুরুমহারাজ কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটাই তুলে ধরার প্রয়াস পেলাম ৷ বাকি দুটি অবস্থার ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আমরা জানবো পরের দিন ৷ যাইহোক, প্রবর্ত্ত অবস্থা সম্বন্ধে আমরা যা জানতে পারলাম, তা হোলো – প্রবর্ত্ত অবস্থার সাধকদের লক্ষণ হোলো তাঁদের মতে শ্রদ্ধা এবং দাস্যভাব থাকবে। আর তারা নাম [তারকব্রহ্ম নাম,চার যুগের চারটি তারকব্রহ্ম নাম রয়েছে ৷ যথা – সত্যযুগের :- “নারায়ণ পরাবেদা, নারায়ণ পরাক্ষরা ৷ নারায়ণ পরামুক্তি, নারায়ণ পরাগতি ৷”
ক্রেতাযুগের :- ” রাম নারায়ণ অনন্ত মুকুন্দ মধুসূদন ৷ কৃষ্ণকেশব কংসারে হরে বৈকুন্ঠ বামন ৷”
দ্বাপর যুগের :- ” হরে মুরারে মধুকৈটভহারে, গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে । যজ্ঞেশ নারায়ণ কৃষ্ণ বিষ্ণো নিরাশ্রয়ং মাং জগদীশ রক্ষ ৷” কলিযুগের মহামন্ত্র :- ” হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে । হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ৷”] করবে ৷
প্রবর্ত্ত অবস্থায় সদ্গুরুর চরণআশ্রয় করে, গুরুকে প্রসন্ন করে তাঁর কাছ থেকে নাম এবং মন্ত্র গ্রহণ করতে হয়। আর শুদ্ধচিত্তে নাম-নামী অভেদজ্ঞানে জপ করতে হয় এবং নামে রুচি আনতে হয় ৷ প্রবর্ত্তের চিত্তশুদ্ধি হয় – এরফলে সাধকের মধ্যে সাত্ত্বিকভাব আসে এবং এই অবস্থায় সদ্গুরু প্রসন্ন হন এবং প্রবর্ত্তকে দীক্ষামন্ত্র দান করেন ৷ এবারে ওই মন্ত্র জপ করতে করতে ঐ ব্যক্তি ‘প্রবর্ত্ত’ অবস্থা থেকে ‘সাধক’ অবস্থায় উন্নীত হ’ন ।৷