এরপরে উনি বলেছেন – ” এই জীবাত্মা (তটস্থা অবস্থা) যখন মায়াশক্তির রাজ্যে অবস্থান করে তখন সে মায়ার প্রভাবে জীবত্বের অভিমান দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে প্রাকৃত সংসারের সুখ-দুঃখরূপ ত্রিতাপ জ্বালা ভোগ করে থাকে।
বহিরঙ্গা জীব বহিরঙ্গা মায়াশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে থাকে ৷ এটা ‘অভাব’ স্থিতি অর্থাৎ এই অবস্থায় জীব আনন্দস্বরূপ হয়েও__ বহিরঙ্গা মায়া প্রভাবে ভ্রান্তিবশতঃ আনন্দের অভাব অনুভব করে এবং অভাবে চঞ্চল হয়ে ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করে অর্থাৎ সংসারচক্রে যাতায়াত করে ৷ এইজন্য এই স্থিতিকে ‘অভাব স্থিতি’ বলা হয়।
ওই ভগবৎবিমুখ জীবাত্মা আবার যখন গুরুকৃপায় বা ভগবৎকৃপায় ঈশ্বরাভিমুখী হয়, তখন বহিরঙ্গা মায়ার ছায়া তার স্বরূপ হোতে অপসারিত হয়, তখন সে আবার সমস্ত আনন্দ ফিরে পায়। এটা ‘স্বভাব’ অবস্থা ৷ তখন বহিরঙ্গা মায়ার রাজ্যে হোতে জীবাত্মা অন্তরঙ্গা চিৎশক্তির রাজ্যে প্রবেশ করে অর্থাৎ ‘অভাবের স্থিতি’ থেকে ‘স্বভাবের স্থিতি’তে প্রবেশ করে ৷ এই রাজ্যে প্রবেশ করলে জীবাত্মা স্বরূপশক্তির অনন্ত বিলাসের ‘বোধে বোধ’ করে থাকে। বস্তুতঃ চিৎশক্তির বিলাস জীবাত্মার আনন্দবর্ধনে নিযুক্ত থাকে ৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরু মহারাজের আলোচনার দ্বারা আমরা এখন আমাদের (মানবের) জীবনের গভীর গূঢ় রহস্য সম্বন্ধে অবগত হচ্ছি ৷ ওনার কথাগুলি খুব ভালো করে অনুধাবন করলে আমরা নিজেরাই বুঝতে পারব যে, আমাদের নিজ নিজ স্থিতি বা চেতনার Level – এ আমরা কে কোন অবস্থায় রয়েছি। গুরুমহারাজ যা বললেন, তাতে আমরা এটা বেশ বুঝতে পারছি যে, আমরা (সাধারণ মানবেরা) পরমেশ্বরের জীবশক্তি অর্থাৎ ‘তটস্থা’ অবস্থায় রয়েছি। আমরা সংসারের যে ত্রিতাপ জ্বালা, দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে থাকি তা পরমেশ্বরের বহিরঙ্গা ভাব বা মায়াশক্তির প্রভাবেই ৷ এই যে আমাদের (সাধারণ মানবের) মায়াশক্তি দ্বারা আক্রান্ত অবস্থা — এটিকেই বাউলগণ ‘অভাব স্থিতি’ নামে অভিহিত করেছেন ৷
মানবের যে তিনটি স্থিতির কথা গুরুমহারাজ আগে আলোচনা করেছিলেন, সেগুলি হোলো অভাব, স্বভাব ও মহাভাব ! আজকে এখানে মাধবজীবনের ‘অভাব’ এবং ‘স্বভাব’ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে ৷ মানবের স্বভাব স্থিতি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” ভগবৎবিমুখ মানব (জীবাত্মা) যখন গুরুকৃপায় বা ঈশ্বরকৃপায় ঈশ্বরাভিমুখী হয়, তখন বহিরঙ্গা মায়ার ছায়া তার স্বরূপ হোতে অপসারিত হয়, তখন সে আবার সমস্ত আনন্দ ফিরে পায় – এটাই ‘স্বভাব’ স্থিতি।
প্রিয় পাঠক ! এখানে কয়েকটি কথা খেয়াল করুন ! যেমন উনি বললেন – ” ভগবৎ-বিমুখ মানুষ গুরুকৃপায় বা ঈশ্বরকৃপায় ঈশ্বরাভিমুখী হোতে পারে ! তাহলে এটা আমরা বুঝতে পারছি যে, ভগবৎবিমুখ মানুষ গুরুকৃপা বা ঈশ্বরকৃপা না হোলে ঈশ্বরাভিমুখী হোতে পারে না ৷ এখানে আরেকবার আমরা স্মরণ করে নিলাম যে ‘মর্তের গুরুই – ঈশ্বর বা ভগবান ৷’ তাছাড়া আরও একটি কথা উনি ব্যবহার করেছেন, সেটা হোলো – ‘বহিরঙ্গা মায়ার ছায়া অপসারিত হয়’ ৷ এই কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বহিরঙ্গা বা মায়াশক্তি পরমেশ্বরের স্বরূপশক্তিরই রূপ, কিন্তু মানবের উপর এই শক্তির ছায়া পতিত হয় আর তখনই মানব ভ্রান্তিবশতঃ আনন্দের অভাব অনুভব করে এবং মায়াতে আক্রান্ত হয়ে মানব ত্রিতাপ জ্বালা বা যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে থাকে।
কিন্তু যখনই আবার সে ঈশ্বরাভিমুখী হয়, তখন থেকেই তার ‘অভাব অবস্থা’ থেকে ‘স্বভাব অবস্থা’-য় উত্তরণ শুরু হয়। আর যখন ওই মানব সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরপরায়ণ হয়ে ওঠে – তখন সে ‘স্বভাব স্থিতি’ লাভ করে থাকে ৷ ওই মানব (জীবাত্মা) তখন মায়াশক্তির প্রভাব কাটিয়ে চিৎশক্তির রাজ্যে প্রবেশ করে থাকে ৷ এই অবস্থায় জীবাত্মার (মানবের) পরমেশ্বরের স্বরূপ শক্তির অনন্ত বিলাসের বোধ হয়ে থাকে। মানবের যে আনন্দের জগৎ, তা শুধুমাত্র পরমেশ্বরের স্বরূপ শক্তির অংশ চিৎশক্তির বিলাস !